ছোট শহরে ২০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

স্থল, নৌ, রেল—তিন পথের যোগাযোগসুবিধায় বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছে উপজেলা শহরটি। যে নদকে কেন্দ্র করে সবকিছু, সেই ভৈরব ধুঁকছে।

যশোরের অভয়নগরে নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় প্রতিনিয়ত জাহাজ বা কার্গোতে দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার মালামাল আনা-নেওয়া করা হয়। সম্প্রতি নদীবন্দরসংলগ্ন ভৈরব সেতুর কাছে
ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

ভৈরব নদের ওপর নির্মিত নতুন সেতুর ওপর দাঁড়ালেই চোখে পড়ে দুই তীরে শত শত জাহাজ। সারি সারি বাঁধা জাহাজগুলোর কোনোটিতে কয়লা, কোনোটিতে সার, কোনোটিতে গম। বস্তা বা ঝুড়িতে ভরে এসব পণ্য মাথায় নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে জাহাজ থেকে নামছেন শ্রমিকেরা। বিরাট এই ব্যবসাযজ্ঞ হচ্ছে যশোরের ছোট্ট একটি উপজেলা শহর নওয়াপাড়াকে ঘিরে।

যশোরের অভয়নগর উপজেলা শহর নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে পাশাপাশি বয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর-খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় সমান্তরালে মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে। স্থল, নৌ, রেল—এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগের সুবিধায় দেশের অন্যতম বড় ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নওয়াপাড়া।

বছরে বিদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য এখানে খালাস হয়। এখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে রাসায়নিক সার, কয়লা, খাদ্যশস্য ও পাথর। শুধু আমদানি পণ্য নয়, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ পণ্যের বড় বাজার নওয়াপাড়া। সব মিলিয়ে নওয়াপাড়া এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসাকেন্দ্র।

যে নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই ব্যবসাকেন্দ্র, সেই ভৈরব কিন্তু ধুঁকছে। দখল ও ভরাটের কারণে কোথাও শীর্ণ আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায়ী–শ্রমিকদের দাবির পরও দখলমুক্ত হচ্ছে না, হচ্ছে না নিয়মিত খনন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জর্ডান, কানাডা, সৌদি আরব, মরক্কো, অস্ট্রেলিয়া থেকে বড় জাহাজে করে আমদানি করা সার, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য, কয়লা চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে তা নওয়াপাড়ায় আনা হয়। ভারত থেকে স্থলপথে আমদানি করা পণ্য ট্রেনে ও ট্রাকে করে বেনাপোল এবং ট্রেনে করে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়।

প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ পণ্যবোঝাই জাহাজ নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে অবস্থান করে। সেখান থেকে নামানোর পর এসব পণ্য প্রতিদিন স্থলপথে এক হাজারের বেশি ট্রাকে করে এবং নদীপথে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে দেশের উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেওয়া হয়।

নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট ও খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেনের সঙ্গে গত ৩০ নভেম্বর তাঁর নওয়াপাড়ার কার্যালয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে সরকার সার ব্যবস্থাপনার বেসরকারীকরণ করে। এতে বেসরকারি পর্যায়ে নওয়াপাড়ায় সার ব্যবসা শুরু হয়। তখন বিদেশ থেকে আমদানি করা সারের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নওয়াপাড়া থেকে বিপণন হতো। এখনো ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ সার নওয়াপাড়া থেকে বিপণন হয়। ধীরে ধীরে সারের সঙ্গে খাদ্যশস্য, সিমেন্ট, রড, পাথর এবং সর্বশেষ কয়লার ব্যবসা যুক্ত হয়েছে। ব্যবসা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে নওয়াপাড়ায় তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

গত ৩০ নভেম্বর সকালে যশোর থেকে সড়কপথে নওয়াপাড়া ঢুকতেই সড়কের পাশে কয়লার স্তূপ চোখে পড়ে। সড়ক ছেড়ে ভৈরব নদের দিকে যেতেই দেখা গেল শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। জাহাজ থেকে মাথায় করে গমের বস্তা নামাচ্ছিলেন খায়রুল ইসলাম। পাঁচ বছর ধরে তিনি ঘাটে শ্রমিকের কাজ করেন। কাজের ফাঁকে তিনি বললেন, সারা বছর ঘাটে মালামাল ওঠানো–নামানোর কাজ থাকে। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ চলে। সব মিলিয়ে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়।

আর্থিক লেনদেনের জন্য এখানে আছে ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। আছে অর্ধশতাধিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানও।

প্রতিদিন লেনদেন হয় কয়েক শ কোটি টাকা। মাত্র আধা বর্গকিলোমিটার এলাকায় বছরজুড়ে চলে এ ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এই ছোট্ট শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। নওয়াপাড়ার এই ব্যবসা–বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল প্রায় তিন লাখ মানুষ।

ভৈরব নদে অবৈধ স্থাপনা

উপজেলার তালতলায় অবস্থিত নওয়াপাড়ায় নদীবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালের মে মাসে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী, উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬টি। ২০১৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও বিআইডব্লিউটিএর সহযোগিতায় দুই ধাপে ৫৯টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। বাকি ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছিল।

নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র বলছে, অভয়নগরের ভাটপাড়া থেকে মহাকাল শ্মশানঘাট পর্যন্ত নদের দুই পারে ৬ কিলোমিটার করে ১২ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে ওই সব অবৈধ স্থাপনা। অবশিষ্ট ২৭টি স্থাপনার মধ্যে আঞ্চলিক কর কমিশনারের ভাড়া করা কার্যালয়, নওয়াপাড়া হাইওয়ে থানার সীমানাপ্রাচীর এবং কয়েকজন প্রভাবশালী বড় ব্যবসায়ীর গুদাম রয়েছে। এ কারণে তখন উচ্ছেদ অভিযান আর এগোয়নি।

করোনাকালে শ্রমিকের পরিবর্তে যান্ত্রিকভাবে (লং বুম এক্সকাভেটর দিয়ে) বার্জ, কার্গো ও কোস্টার থেকে পণ্য খালাস করতে নদের মধ্যে ২২টি জেটি নির্মাণ করা হয়। মাটি ভরাট করে তৈরি এসব জেটিও পরে আর অপসারণ করা হয়নি।

এই জেটি অপসারণসহ তিন দফা দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ এবং নদীবন্দর কার্যালয় ঘেরাও করেন হ্যান্ডলিং শ্রমিকেরা। তাঁদের তিন দফা দাবি—ভৈরব নদ থেকে জেটি সরাতে হবে, নদ খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং উপজেলার রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত নদের তীরে গাইডওয়াল তৈরি করতে হবে।

নওয়াপাড়া নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মো. শাহ আলম মিয়া ২৩ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে ২৫টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অভিযান চলবে। নদে ড্রেজিং চলমান রয়েছে। এখন আর নাব্যতা–সংকট নেই। গাইডওয়াল নির্মাণের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে এটির নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে।

অবশ্য সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, যে ২৭টি স্থাপনা উচ্ছেদের কথা ছিল, সেগুলোর কোনোটিই উচ্ছেদ হয়নি। এর বাইরে কয়েকটি জেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো আবার স্থাপন করা হয়েছে।

যে ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে ব্যবসাকেন্দ্রটি টিকে আছে, সেই নদ সচল না থাকলে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারাবেন। অভয়নগর নওয়াপাড়া পৌর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন মণ্ডল বলেন, এখানে মৌসুমে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শ্রমিক এবং অন্য সময়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু নদী না থাকলে শ্রমিকদের কাজ থাকবে না।

উন্মুক্ত স্থানে শত শত কয়লার স্তূপ

যশোর-খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথ এবং ভৈরব নদের পারে খোলা আকাশের নিচে শতাধিক বড় বড় কয়লার স্তূপ রয়েছে। এর বিরুদ্ধে এলাকার বাসিন্দারা বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন। এ নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি অভয়নগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় নওয়াপাড়া আবাসিক এলাকা এবং যশোর-খুলনা মহাসড়ক ও রেলপথের পাশ থেকে স্তূপ করা কয়লা এক সপ্তাহের মধ্যে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত এখনো ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়লাশ্রমিকেরা বলেন, প্রায়ই কয়লার স্তূপে আগুন ধরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠে। তখন শ্রমিকেরা পানি ছিটান। অনেক কয়লা থেকে দুর্গন্ধও বের হয়। ভৈরব নদ ও মহাসড়কের পাশে ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্র-শিক্ষকেরাও কয়লার দূষণের শিকার হচ্ছেন। আশপাশের গাছ মরে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ও কাপড়চোপড় ধুলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

কয়লা ওঠানো-নামানোর কাজে যুক্ত শ্রমিকেরাও মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছেন। কয়লাশ্রমিক মাসুম শেখ যেমন বললেন, ‘কয়লা বইলে চোখ জ্বালাপুড়া করে, রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। সারা শরীর চুলকায়।’

ভৈরব নদ খনন

৪৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ভৈরব নদ খননের কাজ শুরু করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, খুলনা থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত ভৈরবের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা থেকে শিরোমণি পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার ভৈরবের অবস্থা মোটামুটি ভালো। শিরোমণি থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১৯ কিলোমিটার ভৈরবের অবস্থা বেশ খারাপ।

ভৈরবের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নওয়াপাড়া নদীবন্দরের প্রায় সাড়ে ১২ কিলোমিটার এলাকা। সব মিলিয়ে নৌপথটির সাড়ে ২৭ কিলোমিটার খননের কাজ চলছে। চলতি মাসে এ খননের কাজ শেষ হবে।

নওয়াপাড়া নদীবন্দরে জেটি আছে আটটি। ব্যবসায়ীরা বলেন, নদীর তীর থেকে জেটি ও পন্টুন অনেক দূরে। তাই সময় ও খরচ বেড়ে যায়। এ জন্য এগুলো ব্যবহার করছেন না তাঁরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ ওয়্যারহাউসের সুবিধা বাড়ায়নি। নদীভাঙন রুখতে গাইডওয়াল, পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য স্থায়ী সিঁড়ি ও মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ড তৈরি করেনি। রাজস্ব দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

নওয়াপাড়া নদীবন্দর দিয়ে প্রতিবছর পণ্য আমদানি বাড়ছে। যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান বলেন, ব্যবসা অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। সব ধরনের জাহাজ যাতে নওয়াপাড়ায় পৌঁছায়, সে জন্য সারা বছর ভৈরব নদটি খনন করতে হবে। বন্দরের অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়ালে ব্যবসায়ীরা আরও আগ্রহী হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বাড়বে।