ছয় দশকে নৌপথ কমে অর্ধেক

  • ১৯৬০ সালে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার।

  • এখন বর্ষায় নৌপথের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার।

প্রতিনিয়ত দখল, ভরাট, নদীর গতিপথের পরিবর্তনের কারণে নৌপথ দিন দিন সংকুচিত হয়েছে
ফাইল ছবি

সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে খরচ হয় কমপক্ষে ৪৫০ টাকা। অথচ একই দূরত্বে নৌপথে খরচ পড়বে মাত্র ২২০ টাকা। স্বল্প খরচে ও নিরাপদে যাতায়াত সম্ভব হলেও দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে নৌপথ কখনোই সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। স্বাধীনতার পর সড়কপথের দৈর্ঘ্য প্রতিবছর বাড়লেও নৌপথ কমেছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশের নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্যের সিকি ভাগের কম অংশে নৌযান চলাচল করতে পারে।

প্রতিনিয়ত দখল, ভরাট, নদীর গতিপথের পরিবর্তনের কারণে নৌপথ দিন দিন সংকুচিত হয়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার। পরের তিন দশকে তা কমে হয় ৬ হাজার কিলোমিটার। ২০০৫ সালে এটি আরও কমে যায়। তখন বর্ষায় নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার আর শুষ্ক মৌসুমে ছিল ৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার।

নৌপথ দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদ-নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে এখন মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে এটি আরও কমে হয়ে যায় ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার। এই হিসাবে, ছয় দশকে (১৯৬০-২০২০ সাল) দেশের নৌপথ অর্ধেক কমে গেছে।

নৌপথ আরও বাড়ানো এবং এ খাতকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রেলের পরে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে সবচেয়ে কম খরচ হয় নৌপথে। ভৌগোলিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশে সব নদীই নৌপথ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ ছিল। এটি করা গেলে পণ্য পরিবহনের খরচ অনেক কমে আসত। এতে ভোক্তাপর্যায়েও পণ্যের দাম কমত। এ ছাড়া সড়কপথের তুলনায় নৌপথে দুর্ঘটনার হারও কম। সার্বিক বিচারে পুরো নৌপথ ব্যবহার করা সম্ভব হলে অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ত।

১৯৭৫ সালে দেশের মোট যাত্রীর ১৬ শতাংশ নৌপথে যাতায়াত করত। ২০০৫ সালে একটি কমে হয় ৮ শতাংশ।

অবহেলিত নৌপথ

বিশেষজ্ঞরা নৌপথে গুরুত্ব দিলেও সরকারের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সড়ক, রেল, আকাশ ও নৌপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় নৌপথ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিবহন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫১ হাজার ৮০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সড়ক খাতে ব্যয় হবে মোট বরাদ্দের ৬২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, রেলে ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং আকাশপথের জন্য ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর নৌপরিবহন খাত পেয়েছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

নৌপথ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণেই বাজেটে এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটে সড়ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে নৌপথ ও রেলপথ—দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ নৌপথ ছাড়া টেকসই যোগাযোগমাধ্যম গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

আইইউসিএন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে দেশের মোট যাত্রীর ৫৪ শতাংশ সড়কপথে, ৩০ শতাংশ রেলপথে ও ১৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাতায়াত করত। ১৯৯৬ সালেও নৌপথে মোট যাত্রীর ১৫ শতাংশ যাতায়াত করত। ২০০৫ সালে একটি কমে হয় মাত্র ৮ শতাংশ। ওই বছর যাত্রীর ৮৮ শতাংশ পরিবহন করেছে সড়কপথ।

তবে এখন নৌপথে কত শতাংশ যাত্রী পরিবহন হয়, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও বিআইডব্লিউটিএর দাবি, মোট যাত্রীর এক–চতুর্থাংশ ও পণ্যের প্রায় অর্ধেক নৌপথে পরিবহন করা হয়।

যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বেড়েছে

বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ২১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার যাত্রী (এক যাত্রী একাধিকবার নৌপথ ব্যবহার করলে সেটিও অন্তর্ভুক্ত হবে) যাতায়াত করেছে। একই অর্থবছরে পণ্য পরিবহন হয়েছে ১৪১ লাখ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার যাত্রী পারাপার করা হয়েছে এবং ৫৫৯ দশমিক ৪৫ লাখ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।

যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়ার পেছনে ঘাট ও নৌপথের উন্নয়ন ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করেছেন বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপপরিচালক এনামুল হক ভূঞা।

নৌপথে যত সুবিধা

নৌপথ ঠিক থাকলে নদীর নাব্যতা ঠিক থাকে, যা সার্বিকভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া নৌপথে দুর্ঘটনার হারও তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৬ হাজার ২০১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫১৬টি দুর্ঘটনাই ঘটেছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন। অন্যদিকে একই সময়ে নৌপথে দুর্ঘটনা ২০৩টি, নিহতের সংখ্যা ২১৯।

দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি খাদ্য চাহিদা পূরণেও ভূমিকা রাখে নদ-নদী। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মীর তারেক আলী বলেন, নৌপথ নষ্ট হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পলি। নিয়মিত ড্রেজিং না করলে পলি পড়ে নৌপথ ভরাট হয়ে যায়। তাই সঠিক পরিকল্পনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ড্রেজিং করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যা বেশি, পরিবহনের চাহিদাও বেশি। দিন দিন এটি আরও বাড়ছে। এ জন্য নৌপথে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই। নৌপথ গুরুত্ব পেলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে।’

বিশ্ব নৌ দিবস আজ

জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এ বছর আজ ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নৌদিবস পালন করবে। ১৯৭৮ সাল থেকে আইএমওর সদস্যদেশগুলো দিবসটি পালন করছে।