‌‌জঙ্গির দাবি তিনি ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন

নিজেকে ছাত্রলীগ কর্মী দাবি করা জঙ্গি মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন
ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের বরমীবাজারের সোহেল রানা ওরফে সোহেল ভান্ডারিকে হত্যার কথা পুলিশি জেরায় স্বীকার করেছেন মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন। জঙ্গি তৎ​পরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার এই যুবকের দাবি, তিনি আগে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁর গোটা পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জঙ্গিগোষ্ঠীর (আইএস) সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটেছে চলতি বছর।  
গত ১৬ আগস্ট সাইট ইন্টেলিজেন্স ঢাকার উত্তরে একজন ‘জাদুকরকে’ হত্যার খবর প্রকাশ করে ছবিসহ। তাতে গেরুয়া পোশাক পরা ছবির ওই ব্যক্তির নাম-পরিচয় অবশ্য প্রকাশ করেনি। পরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আ​সে ছবির ওই ব্যক্তির নাম সোহেল রানা (৩৮)। বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমীবাজার এলাকায় তিনি তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)র উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পল্টনে বোমা হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার শেখ নাইমুজ্জামান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য দিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন ওরফে আবু আবদুর রহমান, আল আমিন ওরফে আবু জিয়াদ, মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে রোকন ওরফে আবু তারিক ও সারোয়ার হোসেন রাহাত নামে চার যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চারজনের বাড়িই গাজীপুরের বরমীবাজারে। দুই দফায় ছয় দিনের রিমান্ড শেষে তাঁদের সম্প্রতি কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সিটিটিসি বলছে, প্রায় ডজনখানেক মামলার আসামি মামুন বিদেশে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। জঙ্গিগোষ্ঠীর কাঁধে ভর দিয়ে তুরস্ক পর্যন্ত গিয়ে ইউরোপের কোনো দেশে ঢুকে পড়বেন এমন ইচ্ছে ছিল। তবে তাঁর আগেই ধরা পড়ে যান।

মামুন আল মোজাহিদের বাবা মোসলেম মাস্টার প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭৬ থেকে ৮৩ পর্যন্ত তিনি শ্রীপুর আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এখন তাঁর ছেলেরা ছাত্রলীগ করে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে তাঁর ছেলেরা যে মিছিল করেছিল, সেটা ছিল সবচেয়ে বড়।
তবে, শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাকিরুল হাসান জিকু বলেন, সুমন (মামুন আল মোজাহিদ) ছাত্রলীগের কেউ নন, কখনো ছাত্রলীগ করতেন না।

জিজ্ঞাসাবাদে মামুন যা বললেন

মামুন বলেন, বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁর বাবার ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই সময় দীর্ঘদিন তাঁর বাবা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরার পর পুলিশ তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করতে আসে। সে সময় তাঁর প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা চলছিল। তাঁর বাবা পালিয়ে যান।

ওই বছরেই বরমী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে তর্কাতর্কি হলে, তিনি মামুনের নামে চাঁদাবাজির মামলা করেন। উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান ফকিরের প্ররোচনায় ওই মামলাটি হয়েছিল। প্রথম মামলায় তিনি এগারোদিন কারাগারে ছিলেন। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ঝগড়াঝাঁটিতে জড়ালে তাঁকে আবারও ২০০৫-০৬ সালের কারখানা লুটের একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই সময় তিনি দুই মাস ১১ দিন জেল খাটেন। ওখানে তাঁর সঙ্গে ডাকাত ‌আলমের পরিচয় হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরও ডাকাত আলমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল।
তিতুমীর কলেজে ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময় ২০০৮ সালে অস্ত্র ও মাদক মামলায় আলমের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই মামলায় ১৭ মাস জেলে ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সবার সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলেন। সাইফুরস এ ভর্তি হয়ে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আর পরীক্ষায় বসেননি। তবে বাড়িও আর ফিরে যাননি, গাজীপুরের কালীগঞ্জে চলে যান। সেখানে বিদ্যাময়ী ক্যাডেট স্কুলে চাকরি নেন। কয়েক বছর সেখানে থাকলেও চাকরি করেন মাস দু-এক। এই সময় তাঁর ছোট ভাই ও তাঁর নামে আরও কয়েকটি মামলা হয়। ২০১৬ সালে আইএস এ যোগ দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি থাকায় তিনি পিছিয়ে আসেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে মামুনের ছোট ভাই রাজীব ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। মামুনের দাবি ইউপি চেয়ারম্যান শামসুল হক বাদল সরকারের প্ররোচনায় তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে হিযবুত তাহ্‌রীরে সম্পৃক্ততার দায়ে মামলা হয়। র‍্যাব ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে; এই খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে শুনতে পান র‍্যাব ও পুলিশ তাঁকে ‌‌‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার জন্য খুঁজছে। এরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান ফকির প্রথম আলোকে বলেন, মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমনকে তিনি সাত-আট বছর ধরে এলাকাতেই দেখেননি। এর আগেও তাঁকে মামলায় ফাঁসানোর কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। অন্যদিকে বরমী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক বাদল সরকার বলেছেন, জান বাঁচাতে মোসলেম মাস্টারের ছেলেরা দলের মিছিল-মিটিং এ উপস্থিত থাকত। তাঁর ছেলেদের সারাক্ষণ পুলিশ খোঁজে। স্থানীয় বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, মামুন ও তাঁর ভাইয়েরা এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষেরই উঠবোস নেই।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে মামুন পুলিশতে জানিয়েছেন, তিনি চলতি বছর আত্মগোপনে থেকেই শেখ মইনুল নামে যোগাযোগ অ্যাপ টেলিগ্রামে একটি আইডি খুলে অন্য একটি আইডিকে অনুসরণ করতে থাকেন। ওই আইডির মাধ্যমেই টেলিগ্রামের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হন। বায়াত নেওয়ার পর তারা তাঁকে একটি অপারেশন চালাতে বলেন। মামুন কথা মতো তাঁর রোকন ও আল আমিনকে নিয়ে একটি দল গঠন করেন। তাঁদের এ বছরের ১ জিলহজের মধ্যে অপারেশন শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। টার্গেট হিসেবে ঠিক করে দেওয়া হয় পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও অন্য ধর্মাবলম্বী কাউকে। মামুন কথাবার্তা বলার সময় সরকার বিরোধী অনেক কথা বলে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, অপারেশন না করলে টিকতে পারবেন না। রোকন ও আল আমিনকে ‌টার্গেট ঠিক করতে বললে তাঁরা সোহেল রানাকে বেছে নেন। সোহেল রানাকে এলাকার লোকজন সোহেল ভান্ডারি, সাধু বাবা নামে ডাকত। বরমি বাজারে তাবিজ-কবজ আর টুকটাক কবিরাজি চিকিৎসা করতেন তিনি।

আরও পড়ুন

খুন হলেন সোহেল রানা

সোহেল রানা

ঘটনার দিন সোহেল রানাকে কবিরাজির জন্য মামুন ও তাঁর সহযোগীরা ডেকে আনেন স্থানীয় মাঝিপাড়া গ্রামের ইটভাটায়। এর আগেই বরমীবাজার থেকে চাকু, রশি, রেইনকোট, হাত মোজা, গামবুট, পাথর, ঘুমের ওষুধ কিনেছিলেন তাঁরা। সাধু বাবাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি খাননি। পরে তাঁকে গাঁজা খাওয়ানো হয়।
ওই সময়ও তাঁরা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কিন্তু জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা বারবার তাদের জবাই করার জন্য বলতে থাকে। নইলে তাঁদের দল থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে জানায়। ফজরের আজানের পর তারা সাধুবাবার হাত,পা, মুখ বেঁধে ফেলে। মামুন নিজেই জবাই করেন সোহেল রানাকে। রাহাত তাঁকে সাহায্য করেন। ভিডিও করেন আল আমিন। পরে লাশের নাড়ি-ভুড়ি বের করে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে শীতলক্ষার কাপাসিয়া অংশের কাছাকাছি নদীতে ফেলে দেন।
অপারেশন শেষ হওয়ার পর একটি বিকাশ নম্বর থেকে তাঁদের কাছে কেনাকাটা বাবদ ১৩ হাজার টাকা পাঠানো হয়। তাঁদের দুটি আইডি দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আইডি দুটির একটি যাঁর তিনি বিপদে পড়েছেন বলে পরিকল্পনা স্থগিত করেন। একে একে কয়েকজনই বিপদে পড়েছেন বলে জানান। শেষে আরেকটি আইডি থেকে তাঁদের এলাকা ছাড়তে বলা হয়। ওই রাতেই মামুন গ্রেপ্তার হন।
সোহেল রানার বাবা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, কুড়ি-বাইশ দিন আগে তাঁর বাড়িতে গাজীপুর থেকে পুলিশ এসে সোহেল রানার খোঁজখবর করে। তবে ছেলের পরিণতির কথা জানতে পারেন গত ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে খবর প্রকাশের পর।