জনপ্রতি বরাদ্দের সাত গুণ ব্যয়

১৮ দিনের প্রশিক্ষণে বরাদ্দ ছিল জনপ্রতি ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।

চিকিৎসকদের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে জনপ্রতি বরাদ্দের প্রায় সাত গুণ ব্যয় করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। একেকজনের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ১৭ হাজার টাকা। বিপরীতে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।

এই প্রশিক্ষণ চিকিৎসকদের নারী-পুরুষের বন্ধ্যত্বকরণ শেখানো হয়। প্রশিক্ষণ কর্মশালার মেয়াদ ছিল ১৮ দিন করে। প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া চিকিৎসকদের যাতায়াত ভাতা এবং ব্যাগ, বই, প্যাড ও কলম দেওয়া হয়। ফলে তাঁদের পেছনে জনপ্রতি লাখ টাকার বেশি ব্যয় দেখানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শুধু চিকিৎসক নয়, প্যারামেডিক, মাঠকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের মোট সাত ধরনের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় বরাদ্দের চেয়ে বাড়তি ব্যয় করেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এই বাড়তি ব্যয়কে ‘অস্বাভাবিক’ বলেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প তদারককারী প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এ নিয়ে তাদের একটি নিবিড় প্রতিবেদন গত জুন মাসে প্রকাশ করা হয়।

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের (সিসিএসডিপি) মাধ্যমে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য জনসংখ্যা বাড়ার হার কমিয়ে আনা। এটি ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে উঠে আসা বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সিসিএসডিপি কর্মসূচির বর্তমান লাইন ডিরেক্টর ডা. নুরুন নাহার বেগমের বক্তব্য চেয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হয়। পাশাপাশি ফোন করা হয়। তবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। গত ১৩ জুলাই নুরুন নাহারের কার্যালয়ে গেলে তিনি ও অন্য কর্মকর্তারা দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

সিসিএসডিপির সাবেক লাইন ডিরেক্টর মো. মইনুদ্দীন আহমেদের কাছে বরাদ্দের চেয়ে বাড়তি খরচের কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘কত খরচ করা হয়েছে, তা আমার মাথায় নেই।’

* বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। * প্রশিক্ষণসংশ্লিষ্ট কর্মসূচির ব্যয় ৩৩% বাড়ানোর প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।

বাড়তি ব্যয় ৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিসিএসডিপি কর্মসূচির বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় (অপারেশন প্ল্যান) মোট ১ হাজার ৫০ জন চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে শুরু থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৩৩৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যয় হয় প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। যদিও এ সময়ে ব্যয় করার কথা প্রায় ৫৭ লাখ টাকা। এতেই জনপ্রতি বরাদ্দের সাত গুণ ব্যয়ের চিত্র উঠে আসে।

একই কর্মসূচিতে প্যারামেডিকদের একই ধরনের প্রশিক্ষণে তিন অর্থবছরে ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তারতম্য উঠে এসেছে আইএমইডির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় দেখানো হয়েছিল জনপ্রতি প্রায় ৬২ হাজার টাকা। পরের অর্থবছরে জনপ্রতি ব্যয় করা হয় ৩৯ হাজার টাকার কিছু বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জনপ্রতি ব্যয় করা হয় প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া আঞ্চলিক কর্মশালায় জনপ্রতি ৪ হাজার টাকার কিছু বেশি বরাদ্দ ছিল। তবে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার টাকা করে। মোট বাড়তি ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টাকার বেশি।

এভাবে মোট সাত ধরনের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় বরাদ্দের চেয়ে বাড়তি ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, যা বরাদ্দ আছে, তার চেয়ে বাড়তি ব্যয়ের সুযোগ নেই।

আইএমইডি কিছু প্রকল্প মূল্যায়নের কাজ তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে করায়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এই কর্মসূচি মূল্যায়ন করেছে ইন্টিগ্রেটেড সলিউশন লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ও আইএমইডি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছে, প্রতিবেদনে উঠে আসা সব তথ্যই সঠিক। পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

আইএমইডির উপপরিচালক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যগুলো আমাদের পরামর্শককে ওরাই (পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর) দিয়েছে।’

‘এটা হতবাক করা বিষয়’

চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। সম্প্রতি কর্মসূচিটি সংশোধন করে প্রায় ২৯ শতাংশ (৩৩ হাজার কোটি টাকা) ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কর্মসূচিতে প্রশিক্ষণ বাবদ আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক বিভাগ এই কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে প্রশিক্ষণগুলো আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা হয়। গত ২৮ জুলাই কর্মসূচিটি নিয়ে পিইসির প্রথম দফা বৈঠক হয়। আজ রোববার দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা।

সার্বিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই হতবাক করার মতো বিষয়। বরাদ্দের তুলনায় এত বিপুল অঙ্কের ব্যয় কেন, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের নামে নানাভাবে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা উচিত।