জন্মনিবন্ধন
জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে নাগরিকেরা
২০১১ সালের আগে করা নিবন্ধনের তথ্য অনলাইনে নেই। নতুন করে সনদ করে নিতে হবে অনেককে। সনদ সংশোধনের জন্যও ঘুরতে হচ্ছে মাসের পর মাস।
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শামসুদ্দিন আহমেদের মেয়ের নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে সনদ জমা দিতে হবে। কিন্তু অনলাইনে তাঁর মেয়ের সনদ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি গেলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর কার্যালয়ে। সেখান থেকে জানানো হলো, ২০১১ সালের আগে করা সনদ বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ মেয়ের নতুন করে সনদ নিতে হবে। আর মেয়ের সনদ করতে হলে শামসুদ্দিন আহমেদের নিজের ও তাঁর স্ত্রীরও জন্মসনদ করতে হবে। শামসুদ্দিনের প্রশ্ন, ‘একবার একটা সার্টিফিকেট ইস্যু করার পর কি তা বাতিল করা যায়? আমার তথ্য সরকার হারিয়ে ফেললে সে দায় কি আমার?’
জন্মনিবন্ধনপ্রক্রিয়া নিয়ে শামসুদ্দিনের মতো এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেকে। জন্মনিবন্ধনপ্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হয়েছে। তবে অনলাইনে ফরম পূরণ করার পর তা প্রিন্ট নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবার নির্ধারিত কার্যালয়ে যেতে হচ্ছে। এ ছাড়া কারও সংশোধনের দরকার হলে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি।
২০০৪ সালে জন্মনিবন্ধন আইন করা হয়, কার্যকর হয় ২০০৬ সালে। পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। শুরুতে হাতে লেখা সনদ দেওয়া হতো। এরপর ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে তা ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিবন্ধকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য সরকার আলাদা বরাদ্দও দেয়। কিন্তু সে সময় সব তথ্য ডিজিটাল করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জনবসতি বেশি এমন এলাকাগুলো, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনে তথ্য হালানাগাদ পুরোপুরি হয়নি।
২০১০ সালের পর যে সার্ভারে কাজ করা হতো, তা বছরখানেক আগে পাল্টানো হয়। নতুন এই সার্ভারেও আগের সার্ভারের সব তথ্য স্থানান্তর হয়নি বলেন জানান একটি সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন শামসুদ্দিন আহমেদের মতো অনেকে। পুরোনো সনদ এখন আর কোনো কাজেই আসছে না। নতুন করে সনদ নিতে হচ্ছে।
সংশোধনে ভোগান্তি
জন্মনিবন্ধনে ছেলের নাম সংশোধন নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গৃহিণী রোজী শারমিন। তাঁর ছেলে মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের জন্মনিবন্ধন তিনি নিজ জেলা নেত্রকোনা থেকে নিয়েছিলেন। নামের একটি অক্ষর সংশোধনের জন্য তিন মাস ঘুরেছেন। অনলাইনে নাম সংশোধনের ফরম পূরণ করতে গিয়ে কখনো সার্ভার ডাউন হয়েছে, আবার কখনো ফরম পূরণ করে সাবমিট করার আগে সব তথ্য উধাও হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি আবেদন করতে সক্ষম হন। কিন্তু হয়রানির শেষ হয়নি।
রোজী শারমিন জানান, আবেদন করার পর তাঁদের এক স্বজন নেত্রকোনা পৌরসভা কার্যালয়ে খোঁজখবর নেন। সেখান থেকে তিন-চার দিন পর আবেদনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের দপ্তরে পাঠানো হয়। শুরুতেই তাঁদের আবেদন নাকচ করে দিয়ে নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়। নতুন করে আবার আবেদন করে দিনের পর দিন ওই কর্মকর্তার দপ্তরে ধরনা দিতে হয়। মাস দুয়েক পর নাম সংশোধন করা হয়। কিন্তু সেখানেও একটি ভুল হয়। সেই ভুল সংশোধনের জন্য তাঁকে আবার মাসখানেক অপেক্ষা করতে হয়। রোজী শারমিনের প্রশ্ন, ‘আসলে কাগজে-কলমে আমরা ডিজিটাল। বাস্তবে এখনো অ্যানালগ রয়ে গেছি। ছোট্ট একটা সংশোধনীর জন্য এত ভোগান্তি হবে কেন!’
জন্মনিবন্ধন করার ৯০ দিনের মধ্যে সংশোধন করতে হলে তা নিবন্ধকের কার্যালয় থেকেই সম্ভব। এরপর উপজেলা বা জেলা প্রশাসনে গিয়ে করতে হয়। সংশোধনীর জন্য নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে আবেদন উপজেলা বা জেলা প্রশাসনে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অনুমোদন দেওয়া হলে নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে তা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু আবেদন দিনের পর দিন সংশোধনের জন্য পড়ে থাকে। তখন দ্রুত পাওয়ার জন্য মানুষ সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে গিয়ে ভিড় জমান।
জন্মনিবন্ধন–প্রক্রিয়ায় সরকার আরও একটি নিয়ম যুক্ত করেছে। যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর, তাদের সনদ পেতে হলে মা-বাবার জন্মসনদসহ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে জন্মসনদ কেন প্রয়োজন এই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন জানায়, জন্মনিবন্ধন আইনটি আগে হয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় পরিচয়পত্র হয়। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর চাওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ থেকে যাচাই করা যায় না।
আরও ভোগান্তি
দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম দেখছেন—সিটি করপোরেশনের এমন একজন কর্মকর্তা জন্মসনদ নিয়ে নাগরিকের ভোগান্তির বিস্তারিত জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সাল থেকে যে সার্ভারে কাজ চলছিল, সেখানকার সব তথ্য এখনকার সার্ভারে স্থানান্তর করে নিলে নতুন করে কাউকে জন্মনিবন্ধন করতে হতো না। মানুষের এখন নানান রকম ভোগান্তি। কারণ, পুরোনো জন্মনিবন্ধনের নম্বর দিয়ে পাসপোর্ট করেছে বা ভিসার জন্য ব্যবহার করেছে। এখন তাদের ১৭ ডিজিট নেই। নতুন করে করলে সেই নম্বর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, আগের সার্ভারে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল। এতে বাংলার জায়গাটি অনেকে পূরণ করেননি বা ঠিকমতো করা হয়নি। তাদের এখন আবার বাংলা করার জন্য দৌড়াতে হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান সার্ভারের সক্ষমতার চেয়ে ব্যবহারকারী বেশি। এতে প্রায়ই ডাউন হয়ে যাচ্ছে। নিবন্ধন ফরম ও সংশোধনীর ফরমটাই অনেকে বুঝছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা জানান, সংশোধনীর সমস্যাটা বেশি। এর জন্য মানুষকে নানান জায়গায় দৌড়াতে হয়। আইনের জন্য মানুষ না, মানুষের জন্য আইন। কাজটা সহজ প্রক্রিয়ায় করা যেত। এই কর্মকর্তার মতে, ডিজিটাল করতে গিয়ে জটিলতা হচ্ছে। যাদের ডিজিটাল করা নেই, তারা অনলাইনে নিজের তথ্য হালনাগাদ করতে পারবে—এমন একটা সুযোগ রাখা দরকার ছিল।
জন্মনিবন্ধন কত
বিবিএসের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৭ কোটি। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জানিয়েছে, ৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে জন্মনিবন্ধনের পরিমাণ ১৯ কোটি ৩৫ লাখের বেশি। এ ছাড়া ৬ মার্চ পর্যন্ত সংশোধনের আবেদন জমা ছিল প্রায় ২২ লাখ।
বিবিএসের পরিসংখ্যানের চেয়ে জন্মনিবন্ধন বেশি হওয়ার অন্যতম হিসেবে সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, স্কুল পরিবর্তন বা পছন্দের স্কুলে ভর্তির জন্য অনেক অভিভাবক একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছেন। আগের সার্ভারে একাধিক জন্মনিবন্ধন কেউ করলে তা ধরা যেত না। তবে এখন ধরা যায়।
২০১৪ সালে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে দেশে ‘হাস্যকর’ জন্মনিবন্ধন তথ্যভান্ডার গড়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যখন অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়, তখন তথ্য হালনাগাদ করার দায়িত্ব নিবন্ধকেরই ছিল। সে সময় কাজগুলো সঠিকভাবে হলে এখন মানুষকে দ্বিতীয়বার নিবন্ধন নিতে হতো না। তিনি মনে করেন, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে সে ক্ষেত্রে মা–বাবার জন্মসনদের প্রয়োজন থাকা উচিত না। অবসরপ্রাপ্ত এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই জন্মনিবন্ধন করে নেওয়া সবচেয়ে ভালো। মানুষ যাতে এ সময়ের মধ্যে করে নেয়, তার জন্য আরও প্রচারণার প্রয়োজন। জন্ম-মৃত্যু, জাতীয় পরিচয়পত্রের বিষয়গুলো পরিসংখ্যান ব্যুরো বা সরকারের কোনো একটি সংস্থাকে দিলে ভালো হয় বলে মনে করেন সাবেক এই কর্মকর্তা।
যা বলছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়
বারবার না গিয়ে অনলাইনেই আবেদন করে সনদ পাওয়ার বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল পলাশ কান্তি বালা প্রথম আলোকে বলেন, তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন আছে। প্রক্রিয়া কীভাবে সহজ করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা ভাবছেন।
নতুন করে সনদ নেওয়ার সমস্যার কথা স্বীকার করে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘ম্যানুয়ালি যাদের করা আছে, তাদের নিবন্ধন অনলাইনে আগের নম্বর ঠিক রেখে কীভাবে যুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে।’
সার্ভারের ধীর গতি প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে কিছু ক্লাউড ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এখন গতি বেড়েছে। তিনি আরও জানান, জন্মনিবন্ধন যেকোনো জায়গা থেকে সম্ভব। কিন্তু সংশোধন করতে হলে যেখানে নিবন্ধন করা হয়েছে, সেখানেই যেতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহেমদেরও জন্মনিবন্ধন নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিজিটাল করা মানে এটা অটোমেশন হবে। যেটা হয়েছে তা হচ্ছে কম্পিউটারাইজড। আগে খাতায় লিখতেন, এখন কম্পিউটারে লিখে রাখে।’
সুমন আহমেদ বলেন, ‘শহরে প্রায় সব বাচ্চার জন্ম হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে একটি সার্টিফিকেটও দেওয়া হয়। তাহলে কেন নিবন্ধনের জন্য সিটি করপোরেশনে কাছে যেতে হবে? হাসপাতাল থেকে তথ্য যাবে সিটি করপোরেশনে। তারা অভিনন্দন বার্তাসহ একটি জন্মনিবন্ধন নম্বর ওই মা–বাবার কাছে পাঠাবে।’ করোনার টিকা নিবন্ধনের প্রক্রিয়ার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় কাজ সুন্দরভাবে চাইলেই সম্ভব।