জন্মশতবর্ষে এক অনন্য নিবেদন

সত্যজিৎ রায়

‘গত বিশ বছরে অনেক জায়গায় অনেক দেশে অনেকবার নানাভাবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু আমি জোর গলায় আজকে এখানে দাঁড়িয়ে এই শহীদ দিবসের পুণ্য তিথিতে বলতে পারি যে আজকের যে সম্মান, সে সম্মানের কাছে আগের সমস্ত সম্মান হার মেনে যায়।’

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পল্টন ময়দান। ২০ তারিখের এক শীতল ও হ্রস্ব দিনে শরীরে মোটা একটি চাদর জড়িয়ে কথাগুলো যখন বলেছিলেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, শিল্পনির্দেশক, সংগীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়, তখন সেটিকে নিয়মমাফিক ভদ্রতাসূচক কিছু সাধারণ মন্তব্য হিসেবে নেওয়া যেত। কিন্তু না, কথাগুলো তিনি বিশ্বাস থেকেই বলেছিলেন। কারণ, তাঁর শিকড় বাংলাদেশে, পূর্বপুরুষের স্মৃতিমাখা যে ভূখণ্ডকে সব সময় অনুভব করতেন তিনি।

১৯২১ সালের ২ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কিংবা পিতা সুকুমার রায়কেও প্রতিভার সব দিক দিয়ে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। এ বছর জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা প্রকাশ করেছে সত্যজিৎ স্মৃতি। বইটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক পিয়াস মজিদ। মূলত সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক এ বইটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর লেখক ও বিষয়বৈচিত্র্য।

সত্যজিৎ রায়কে নিবেদিত কবি শামসুর রাহমান ও বেলাল চৌধুরীর কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে সত্যজিৎ স্মৃতি। এরপর ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে আমন্ত্রিত সত্যজিতের ওই বক্তৃতাটি। পরের লেখাটি চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর। সত্যজিৎকে পুনেতে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই বছর পর সত্যজিতের সঙ্গে লন্ডনে দেখা হয়েছিল সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। সেই সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ সতর্ক করেছিলেন সৈয়দ হককে, ‘বাংলাদেশে না প্রতিক্রিয়াশীলেরাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি শঙ্কা করি। আমি শঙ্কা করি।’ ’৭৩ সালে করা সেই শঙ্কা আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে আমাদের সামনে।

সৈয়দ হক মূলত লিখেছেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎকে নিয়েই। অস্কারজয়ী সিনেমা পথের পাঁচালী নিয়ে যেমনটি লিখেছেন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। তাঁর লেখায় আমরা জানতে পারি, এই সিনেমায় সর্বজয়া চরিত্রে রূপদানকারী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে মৃৎশিল্প বিভাগে খণ্ডকালীন ছাত্রী ছিলেন।

আলোকচিত্রী আমানুল হকের তোলা একটি ছবি দেখে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘আমার সেকেন্ড বেস্ট পোর্ট্রেট।’ এ বিষয়ে আমানুল হকের স্মৃতিমূলক নিবন্ধটি ঋদ্ধ করেছে সত্যজিৎ স্মৃতিকে, যেভাবে ঋদ্ধ করেছে অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক সৈয়দ হাসান ইমামের লেখাটিও। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে সন্দীপের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি।

পরের লেখাটি বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাঈদা খানমের। চিত্রালী পত্রিকার হয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিতে কলকাতায় গিয়েছিলেন তিনি। পরে সত্যজিতের তিনটি ছবিতে কাজ করেছিলেন আলোকচিত্রী হিসেবে।

সত্যজিৎ স্মৃতি সংকলন ও সম্পাদনা: পিয়াস মজিদ প্রথমা প্রকাশন, প্রচ্ছদ: শহিদ কবীর

সত্যজিৎ স্মৃতিকে আলাদা মাহাত্ম্য দিয়েছে অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নেওয়া চিত্রনায়িকা ববিতার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। অশনি সংকেত-এ অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। সে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া থেকে শুরু করে সত্যজিতের সঙ্গে যোগাযোগ, অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, ‘গোল্ডেন বিয়ার’ জেতার পর বার্লিন যাওয়ার অপূর্ব স্মৃতি ইত্যাদি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তিনি।

ষাটের দশক থেকে সত্যজিতের সিনেমা ও লেখালেখি সম্পর্কে আগ্রহ ছিল প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের। একটি মাথা কাটা ছবিকে কেন্দ্র করে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর অসাধারণ লেখা। সত্যজিৎ-সংশ্লিষ্ট দুটি প্রসঙ্গের দিকে তিনি আলো ফেলেছেন—প্রথম চারটি সিনেমার সফলতার পরও সত্যজিৎ আর কখনো সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব বন্ধু সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করকে কেন দিলেন না এবং কোনো ধরনের আলোচনা-সমালোচনার তোয়াক্কা না করে খ্যাতিমান সব শিল্পীকে বাদ দিয়ে কেন দুটি সিনেমায় রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ালেন কিশোর কুমারকে দিয়ে। তাঁর লেখাটি এ বইকে ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড নিয়েও সত্যজিৎ সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন, তখনকার বাংলাদেশের পরিস্থিতির জন্য যেটা আর হয়নি। সেলিনা হোসেনের লেখাটি এ প্রসঙ্গে সত্যজিতের তিনটি চিঠির প্রামাণ্য সংকলন।

১৯৮৪ সালে টগবগে দুই তরুণ লুৎফর রহমান রিটন ও আলী ইমাম তুমুল উত্তেজনা নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন—সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করতে। সেদিন তাঁদের ২২ মিনিট সময় দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, যিনি মাত্র কিছুদিন আগেই অ্যাপয়েনমেন্ট করে যাননি দেখে মন্ত্রীর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পিয়াস মজিদ লিখেছেন সত্যজিতের জন্মস্থান মসূয়া নিয়ে। বাংলাদেশে সত্যজিতের শিকড়ের এক বিস্তর সন্ধান তিনি করেছেন তাঁর লেখায়।

পরিশিষ্টে যুক্ত দেবাশিস মুখোপাধ্যায় গ্রন্থিত সত্যজিৎ রায়ের জীবনপঞ্জি এবং শাহ মো. আতিকুল হক প্রণীত চলচ্চিত্র ও গ্রন্থপঞ্জি বইটির গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি করেছে। অঙ্গসজ্জা ও শ্রীবৃদ্ধির পাশাপাশি এর গুরুত্বও বাড়িয়ে দিয়েছে বইয়ে ব্যবহৃত প্রাসঙ্গিক আলোকচিত্রগুচ্ছ। আর শহিদ কবীরের প্রচ্ছদ যেন স্বর্ণপরিচ্ছদ।

এ বইয়ে এই খ্যাতিমান ব্যক্তিরা সত্যজিতের জীবন ও কাজকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রয়াত ও জীবিত এই সৃষ্টিশীল মানুষদের সঙ্গে নানা সময়ে, নানান সূত্রে সম্পৃক্তি ও সংযুক্তি ঘটেছিল তাঁদের একান্ত আপন সত্যজিৎ রায়ের। সেই সময় ও সূত্রকে পরম যত্নে বাঁধা হয়েছে সত্যজিৎ স্মৃতিতে, যা সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে এক অনবদ্য নিবেদন।