জরিপে কেন পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে

লন্ডনভিত্তিক জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ক্যান্টার ২০২১ সালে বাংলাদেশে একটি জাতীয় গণমাধ্যম জরিপ করেছে। সে জরিপে জানা গেছে, প্রতিদিন ৫০ লাখ পাঠক প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকা পড়েন। দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলোর পাঠক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। করোনার অতিমারির সময়েও এই পাঠকসংখ্যা প্রথম আলোকে একটি অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। তারই ভিত্তিতে আজকের এই বিশেষ আয়োজন।

‘জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত শক্তির কথা বলতে গিয়ে ‘দুর্মর’ কবিতায় লিখেছিলেন কবি–কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য। কথাগুলো বোধ করি এখন ছাপা পত্রিকা নিয়েও বলা চলে, বিশেষ করে প্রথম আলোকে নিয়ে।

এক দশক ধরে পৃথিবীতে রোল উঠছিল, ছাপা পত্রিকার রমরমার দিন এবার গেল। নতুন পৃথিবী ডিজিটালের। ডিজিটালের মারে ছাপা পত্রিকা অচিরেই অতীত দিনের স্মৃতিতে পর্যবসিত হতে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছিলেন, পশ্চিমা দুনিয়ায় যা–ই ঘটুক না কেন, এই উপমহাদেশসহ এশিয়ায় অন্তত আরও পনেরো–কুড়ি বছর পত্রিকা জোরালোভাবে টিকে থাকবে। এসব বাগ্​বিতণ্ডার মধ্যেই করোনার অতিমারি এসে পৃথিবী ওলট–পালট করে দিল। মৃত্যুর ত্রাসে শঙ্কিত মানুষ বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় পৃথিবীর সামনে রুদ্ধ করে দিল ঘরের দরজা। পত্রিকার জন্য হঠাৎই যেন চলে এল কঠিন এক সময়। পত্রিকায় ছাপানো ‘সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’।

কিন্তু না, যে আশঙ্কা সবার মনে জেগেছিল, ঘটনা তত দূর সত্য হয়ে উঠতে পারেনি। অতিমারির রেশ মিলিয়ে যেতে যেতে মানুষ ফিরে এসেছে মুখর জীবনে। যতই তারা ফিরে এসেছে, ততই নতুন শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছে ছাপা পত্রিকা। এর মধ্যে প্রথম আলোর প্রত্যাবর্তনটা হয়েছে পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো। গাঢ় ছায়ায় আচ্ছন্ন অতিমারি থেকে প্রথম আলো যে সবাইকে বহুদূর পেছনে ফেলে জেগে উঠেছে নতুন প্রাণশক্তিতে, ক্যান্টারের ‘জাতীয় গণমাধ্যম জরিপ ২০২১’ (এনএমএস) তারই এক আনন্দ–ঘোষণা। সে জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে যে প্রতিদিন ৫০ লাখ পাঠক প্রথম আলো পড়ছেন। ক্যান্টার লন্ডনভিত্তিক জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সাল থেকে দুই বছর পরপর করা তাদের জাতীয় গণমাধ্যম জরিপের তথ্য আস্থার সঙ্গে ব্যবহার করে আসছেন বাজার গবেষক ও পরিকল্পনাকারীরা।

দুই.

এমন তথ্য প্রথম আলোর জন্য নিশ্চয়ই একটি আনন্দ–সংবাদ। কিন্তু অতিমারির দীর্ঘ স্থবিরতার পরে প্রথম আলোর এত দ্রুত উত্থানের রহস্য কোথায়, সেটিও বুঝে দেখতে হয়।

সেটি বোঝার জন্য ছাপা পত্রিকার জগতে একটু ঘুরে আসা দরকার। ডিজিটাল পরিসরই যে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ, সে সত্য থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা অবাস্তব। ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই দ্রুত বয়ে চলেছে। তারপরও ছাপা পত্রিকার এই রহস্যময় শক্তির উৎস কী! পত্রিকা তথ্য দেয় বটে, পাঠক সে তথ্যটুকু নেন; তবু তথ্যই সেখানে একমাত্র নয়। তথ্যের অন্তরাল থেকে পত্রিকা থেকে পাঠক পান প্রত্যয়, নিশ্চয়তা, নির্ভরতা। অনিশ্চিত পৃথিবীতে যে তথ্য নিয়ে তিনি পথ হাঁটবেন, সেটি তাঁকে সুনিশ্চিত পথরেখা ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নাকি কোনো চোরাবালিতে নিয়ে ফেলবে, পত্রিকা তাঁকে সে ব্যাপারে আস্থা আর প্রামাণিকতা দেয়।

তথ্যমাত্রই সাংবাদিকী প্রতিবেদন নয়; তথ্যকে যে প্রক্রিয়ায় প্রতিবেদন হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তার গভীরে পাঠকের আস্থার ভিত্তি। একাধিক উৎস থেকে তথ্য যাচাই, সূত্রের পর্যবেক্ষণ ও উল্লেখ, সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র পর্যালোচনা ইত্যাদি কয়েক শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তথ্য হয়ে ওঠে পরিবেশনযোগ্য বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা।

অনলাইনের মূল ঝোঁক এখনো তাৎক্ষণিকতায়। পত্রিকার হাতে সময় থাকে কিছুটা বেশি। এর ঝোঁক এখন ঘটনার পেছনের ঘটনায় আর গভীরতর বিশ্লেষণে।

যে পত্রিকা এই প্রক্রিয়া যত বেশি নিষ্ঠা ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে অনুসরণ করে, পাঠকের কাছে সে পত্রিকাই ধীরে ধীরে তত আস্থা আর বিশ্বাসের ভিত্তি হয়ে ওঠে। প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার শক্তি ঠিক এখানেই।

তিন.

সাংবাদিকতার পথজুড়ে একদিকে নানা ঝুঁকি ও ফাঁদ, অন্যদিকে বিচিত্র প্রলোভন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো নির্মীয়মাণ। সাংবাদিকতার কর্তব্য, দায় ও সীমানার বোঝাপড়া নিয়ে তর্ক এখনো তীব্র। ঝুঁকি তাই এখানে অনেক বেশি। প্রথম আলো তাই শুরু থেকেই সাংবাদিকতার কঠোর নীতি আর নিরিখের ওপর জোর দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। আর ছিল তার কঠোর সত্য প্রকাশের সাহস। উদাহরণ দেওয়া যাক।

২০০৪ সালে দেশে উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে প্রথম আলো কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকারের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এ নিয়ে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) সে বছরের ২৩ আগস্ট লেখে, ‘ইসলামি উগ্রবাদী জঙ্গিদের প্রসঙ্গ বাংলাদেশে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যেসব বিদেশি পত্রপত্রিকা এদের অস্তিত্ব বা তৎপরতা সম্পর্কে খবর দিয়েছে, সরকার তাদের আক্রমণ বা নিষিদ্ধ করেছে। ২০০২ সালে এ পরিণতি হয়েছে ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ আর টাইম–এর। বাংলাদেশে প্রথম আলোই প্রথম কোনো পত্রিকা, যারা এ বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপাল।’

এবার আসা যাক সাম্প্রতিক সময়ে। এই মার্চেই সরকার আমির হামজা নামের একজনকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানে ভূষিত করেছিল। প্রথম আলো আমির হামজাকে নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার সেটি ফিরিয়ে নেয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, এ সম্মাননা ছিল পুরস্কার কমিটির ব্যর্থতা।

প্রথম আলোর এই নীতি ও প্রক্রিয়া, দলনিরপেক্ষতা ও সাহসী সাংবাদিকতাকে পাঠকও বিপুল ভালোবাসায় শতগুণে ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশের দুই বছরের মাথায় প্রথম আলো হয়ে উঠেছিল দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা, সাড়ে তিন বছরের মধ্যে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর।

শেষ বিচারে এই ভালোবাসা আসলে বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতার প্রতি পাঠকদের তৃষ্ণা আর আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। তাই প্রথম আলো নিজের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিসরটিও একই সঙ্গে রচনা করেছে। আমরা সম্ভবত বলতে পারি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিসর রচনার জন্য প্রথম আলোর এ এক নীরব বিনীত সাংবাদিকী প্রচেষ্টা।

চার.

দীর্ঘদিনের এই নীরব বিনীত প্রচেষ্টায় বাংলাভাষী পাঠকের যে অপরিসীম ভালোবাসা প্রথম আলো পত্রিকা অর্জন করেছে, তারই শক্তিতে মাসে ১ কোটি ৪০ লাখ ইউজার আর ২৫ কোটি পেজভিউ নিয়ে প্রথম আলো এখন পৃথিবীর শীর্ষতম বাংলা সংবাদমাধ্যম।

পাঠক, আপনাকে অভিনন্দন, আপনাকে ভালোবাসা।

সাজ্জাদ শরিফ: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো