জলবায়ু পরিবর্তনের ‘বড় প্রভাব’ মাতৃস্বাস্থ্যে

শনিবার রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড উইমেনস হেলথ’ বিষয়ে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা
ছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে মাতৃ ও প্রজননস্বাস্থ্য। মাতৃস্বাস্থ্যের এই ঝুঁকি সন্তানের ওপরও প্রভাব ফেলে। বাড়ে অপরিণত শিশুর জন্ম, কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু ও মৃতজন্মের হার। জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবের শিকার হয়ে কিশোরীদের বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার ঘটনাও বাড়ে।

আজ শনিবার ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড উইমেনস হেলথ’ (জলবায়ু পরিবর্তন ও নারীদের স্বাস্থ্য) বিষয়ে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনে এই সম্মেলনের আয়োজন করে প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। সম্মেলনে দেশের পাঁচ খ্যাতিমান প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে সম্মাননা দেওয়া হয়।

অনলাইন ও সরাসরি দুভাবে সম্মেলনে যোগ দেন দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানি, খাবার ও জ্বালানির অভাবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে নারী ও শিশু। এর প্রভাবে অপুষ্টি দেখা দেয়। অপুষ্টিতে ভুগলে উন্নয়নের অংশীদার হওয়া সম্ভব হয় না। পুষ্টি মানুষের শরীরে–মনে শক্তি জোগায় এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য দায়ী দেশগুলোকে ভুক্তভোগী দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে সংকট মোকাবিলা করতে হবে।

সম্মেলনে অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেসব নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা শনাক্ত করে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। মা ও গর্ভের শিশুর ঝুঁকির কথা বিবেচনায় বিভিন্ন পর্যায়ে সেবার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে। খাবার বিষমুক্ত রাখতে কীটনাশক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। একইভাবে নজর দেওয়া হয়েছে বায়ু, পানি ও পরিবেশদূষণের বিষয়েও।

সম্মেলনে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ’ (জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রজননস্বাস্থ্য) বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ওজিএসবির সাবেক সভাপতি টি এ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে অপুষ্টির হার কমলেও এখনো স্কুল–পূর্ববর্তী সময়ের শিশুদের ৫৬ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। সংখ্যার দিক দিয়ে যা ৯৩ লাখের মতো। ৫৬ শতাংশ শিশু কম ওজনের। উন্নয়নশীল বিশ্ব কার্বন নিঃসরণে সবচেয়ে কম ভূমিকা রাখলেও দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবের ভার সবচেয়ে বেশি বহন করতে হচ্ছে। ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য ও দারিদ্র্য বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে আরও ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লোনাপানিতে জমিগুলো লবণাক্ত হয়ে খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়, মানুষের স্থানান্তর ঘটে, আয়ের সক্ষমতা, শিক্ষার সুযোগ ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার সংকুচিত হয়, যা নারী ও মেয়েশিশুর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। বাল্যবিবাহ বাড়ায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা পাওয়ার সুযোগ কমে যায়, অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভকালীন সেবা ও প্রসবসেবার সুযোগ কমে যায়।

ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম ‘হেলদি অ্যান্ড গ্রিন রিকোভারি’ (সুস্বাস্থ্য ও সবুজ পুনরুদ্ধার) বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে আর্থিক ক্ষতি ও সংকট মোকাবিলার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জানান, আর্থিক বিবেচনায় ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবছর সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে আনুমানিক ২ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে। স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, পানি ও স্যানিটেশন খাত যুক্ত করা হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

যেসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো দুর্বল বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি যথাযথ সহযোগিতার হাত না বাড়ালে দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের বিরুদ্ধে সাড়া দেওয়া ও প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন, খাদ্যনিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ পানির সুযোগ কমে যাচ্ছে। বাড়ছে কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু, অপরিণত শিশু জন্ম, মৃতজন্ম এবং নারীদের গর্ভধারণ, প্রসবসংক্রান্তসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতার হার।

অনলাইনের মাধ্যমে সম্মেলনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবসটেট্রিকসের (ফিগো) প্রেসিডেন্ট জেনি কনরি এবং সংস্থার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অ্যানি বিট্রিস কিহারা। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন ওজিএসবির সাধারণ সম্পাদক গুলশান আরা।
‘হাসি সবচেয়ে বড় ওষুধ’ এই সূত্র ধরে সম্মেলনে উপস্থিতদের নিয়ে আনন্দ আয়োজনে মাতেন মীরাক্কেল তারকা আবু হেনা রনি। সংগীত পরিবেশন করেন রিফাত হুসেইন।

ফিগো পুরস্কারপ্রাপ্ত ৫ চিকিৎসককে সম্মাননা

দেশে মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফিগো পুরস্কারপ্রাপ্ত পাঁচ প্রসূতিবদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে সম্মাননা জানানো হয়। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ফিগো পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন জাতীয় অধ্যাপক এবং কোভিড–১৯ বিষয়ে জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির সদস্য শাহলা খাতুন, কমিটির আরেক সদস্য রওশন আরা বেগম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান কোহিনূর বেগম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রসূতিবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান লতিফা শামসুদ্দিন এবং আদ–দ্বীন মহিলা‍ মেডিকেল কলেজের জ্যেষ্ঠ পরামশর্ক আনোয়ারা বেগম।