জলাবদ্ধতার তথ্যের ভ্রান্তিবিলাস

বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরের বিভিন্ন সড়কে। সোমবার বেলা পৌনে তিনটায় রাজধানীর মিরপুর রোডে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ধরুন, আপনি ডাল রান্না করবেন। এ জন্য আপনার জানা দরকার, কী কী উপাদান লাগবে, আর কীভাবে তা রান্না করতে হবে। কোনো কারণে একটি উপাদানের আনুপাতিক হার কম বা বেশি হলে তা ডাল না হয়ে অন্য কিছু হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এই ছোট্ট উদাহরণ আমাদের নদী ও জলাবদ্ধতা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সঠিক তথ্য ও কাজের পদ্ধতি ঠিক না থাকায় এ খাতে ঠিকই টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা কোনো কাজে আসছে না। কারণ, এ কাজের জন্য সংগ্রহ করা তথ্যের মধ্যে গলদ রয়েছে। যুগের পর যুগ ভ্রান্ত তথ্যকে পুঁজি করে আমরা দেশের নদ-নদী ব্যবস্থাপনা ও শহরের জলাবদ্ধতা দূর করার চেষ্টা করছি। অথচ তথ্য এমন একটা উপাদান, যা যেকোনো নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের সরকারি পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংকলনে উদাসীনতা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের সামাজিক ও জনমিতির তথ্য সংগ্রহ করে। আর ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ও ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভৌগোলিক তথ্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট স্থানিক নির্ভুলতা খুবই জরুরি। তাই ‘বিশেষায়িত’ এই তথ্য সঠিক কি না, তা নিশ্চিতে উপযুক্ত দক্ষতা ও পেশাদারত্ব দরকার।

তথ্য যখন আবর্জনা

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন গত পাঁচ অর্থবছরে ১ হাজার ৩১৬ কোটি থাকা খরচ করেছে। আর ঢাকা ওয়াসা খরচ করেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা (গত তিন বছরে)। এত টাকা খরচ করেও সমস্যার সমাধান নেই।

২০১৯ সালে একটি গবেষণার জন্য আমরা ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহের কাজে হাত দিলাম। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের আমার এক ছাত্রকে এ কাজের দায়িত্ব দিলাম। কিন্তু ড্যাপের তথ্য-উপাত্তের অবস্থা দেখে বেচারা শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। যেমন রাস্তা চলে গেছে ভবনের ওপর দিয়ে। অথচ অনেক টাকা খরচ করে কয়েক বছর সময় নিয়ে ড্যাপের জন্য ঢাকা মহানগরের উপাত্ত তৈরি করা হয়েছে।

একই অবস্থা দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের। যত দূর জানা যায়, সেখানকার জলাবদ্ধতা দূর করতে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল একই। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একই সমস্যার সমাধান করতে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যাহোক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহ করলাম। গবেষণার প্রয়োজনে আমার যা দরকার তার চেয়ে বেশি তথ্য তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেইসে আছে। কিন্তু কাজে লাগানোর উপযোগী তথ্য যৎসামান্য।

দুই নগরে কতগুলো খাল রয়েছে, তার সঠিক তথ্য কোথাও নেই। একেক প্রতিষ্ঠান একেক সংখ্যা বলে। অথচ বিদ্যমান জলাশয়, খালবিলের নির্ভুল স্থানিক ও বর্ণনামূলক তথ্য জলাবদ্ধতা মডেলিংয়ে অপরিহার্য একটা প্যারামিটার।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চলক হচ্ছে ভূমির উচ্চতা। যদিও অনেক চেষ্টার পর একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুই নগরের ভূমির উচ্চতাসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেল। কিন্তু সেই তথ্যেও ব্যাপক গরমিল। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল, এমন কার্যকর কোনো উপাত্ত অন্য কোথাও নেই, বাস্তবে হলো উল্টো। কেননা সরেজমিন থেকে অর্জিত তথ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে করা হয়নি বলে মনে হলো। যাক, অনেক দিনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর জলাবদ্ধতার গবেষণা চুলোয় গেল, মানে ইস্তফা দিলাম।

দেশের তথ্য দেশে নেই, বিদেশে আছে

এ তো গেল দুটি বড় নগরের বন্যা তথা জলাবদ্ধতার কথা। পানি ও নদীভাঙন ব্যবস্থাপনায় তথ্যের ভ্রান্তি আরও ভয়াবহ। দেশের নদ–নদীর ভৌগোলিক এবং পানিপ্রবাহ–সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে, এমন দুটো সংস্থার দ্বারস্থ হই। পানিপ্রবাহের উপাত্ত সরবরাহকারী এক দপ্তরে গিয়ে দেখি, দরজার সামনে সাঁটানো আছে ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’। কিন্তু যখনই উপাত্ত পাওয়ার প্রক্রিয়া জানতে পারলাম, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ!

সেসব কথা থাক, আসি ভৌগোলিক তথ্যের সঠিকতায়। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে এখন ভৌগোলিক তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করা খুবই সহজ। তাই প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখি শুভংকরের ফাঁকি। যেখানে নদী থাকার কথা, সেখানে নদী নেই; বরং ঘরবাড়ি! কৃষিজমির ওপর নদী! এমন অবস্থা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, রাজশাহীর শহরের কাছে ও ফরিদপুরের চরাঞ্চলের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। যেহেতু টাকা খরচ করে তথ্য সংগ্রহ করেছি, একপ্রকার বাধ্য হয়ে আবার ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জানানো হলো বিশদ কিছু বলা সম্ভব নয়, কেননা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি এই তথ্য তৈরি ও সংকলন করেছে। সুতরাং সংকলনের সময় কীভাবে করা হয়েছে, তার কোনো বর্ণনা তাদের কাছে নেই। কিন্তু ভৌগোলিক তথ্য তৈরিতে নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ না করলে শেষ পর্যন্ত তথ্য পরিণত হয় জঞ্জালে। এতে করে সময় ও অর্থ—দুটোরই অপচয়। শেষে ব্রিটিশ লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেল। তথ্য ব্যবহারের সময় আনুষঙ্গিক যা প্রয়োজন হতে পারে, তার একটা ফাইলও দেওয়া হলো। সুতরাং তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগের দরকার হলো না। আহা রে! আমার দেশের তথ্য অথচ বিক্রি করে অন্য দেশের সংস্থা।

তবে উদাহরণও আছে

জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস), স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)—এই তিনটিকে একসঙ্গে ভূসংস্থানিক বিজ্ঞান বা geospatial science বলে। যেহেতু এই শাস্ত্র এক সঙ্গে যেকোনো বিষয়ের স্থানিক এবং কালিক বিশ্লেষণে নির্ভুল তথ্য দিয়ে থাকে, তাই বর্তমান বিশ্বে এই প্রযুক্তি অত্যন্ত জনপ্রিয়, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এই প্রযুক্তির ছোট্ট একটা উদাহরণ হচ্ছে উবার বা পাঠাও, যা আপনাকে কোনো বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে নির্ভুলভাবে পৌঁছে দেয়। এমন কোনো খাত এখন নেই যে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয় না। যেমন পিৎজাহাট খাবারের অর্ডার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এটার সাহায্য নেয়। কাজটি বিভিন্ন উপায়ে করা যায়। সহজ একটা উদাহরণ হচ্ছে গুগল ম্যাপকে ভিত্তি ধরে বাস্তবিক কোনো বস্তুর (যেমন রাস্তা, ঘরবাড়ি) অবস্থান গ্লোবাল ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইটের সমন্বয়ে বস্তুর সুনির্দিষ্ট অক্ষাংশ/দ্রাঘিমাংশ ডেটাবেইসে অন্তর্ভুক্ত করা। উন্নত বিশ্বে অপরাধ রোধে, কর সংগ্রহ, জনসংখ্যার বিন্যাস, পরিবেশ ও জলবায়ুর মডেলিংসহ এমন কোনো খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নেই।

জনপ্রিয়তার কারণে আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা ভূসংস্থানিক তথ্য তৈরি ও ব্যবহার করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা এই উপাত্ত তৈরি করেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগের পেশাদারত্ব ও জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ভৌগোলিক তথ্য তৈরিতে দক্ষতা অত্যাবশ্যক বিষয়, যা আমাদের দেশে এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের ভৌগোলিক তথ্যের ৯০-৯৫ শতাংশ নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, টাকা কামানোর খাতিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দায়সারা গোছের কিছু তথ্য তৈরি করে। তা ছাড়া এসব তথ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। এখানে আসতে পারে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) কথা। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এটাও এখন ধুঁকছে। অথচ এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের রিমোট সেন্সিং (ISRO) সংস্থার আগে। ভারতীয় সংস্থাটি আজ মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠায়, আর আমরা অন্যান্য সরকারি সংস্থার মতো দিনাতিপাত করছি!

ব্রিটিশদের প্রণীত আইনকানুন এখনো আমাদের ভৌগোলিক তথ্যের প্রবেশাধিকারে বড় বাধা। যদিও ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্তমানে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি অনেক বেশি পরিপক্ব এবং নির্ভুল তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও কার্যকর। কিন্তু স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে তথ্য তৈরি ও সংকলনে দক্ষতা খুবই প্রয়োজন, বিশেষ করে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক। ভৌগোলিক তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে স্যাটেলাইট ডেটার সমন্বয়ে পারিবেশিক যেকোনো বিষয়ের কারণ, ফলাফল ও পূর্বাভাস খুব দ্রুত নির্ণয় করা সম্ভব, যা এখন পর্যন্ত আমাদের এখানে অবহেলিত।

পুলিশ ৯৯৯কে ভৌগোলিক তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে অপরাধ রোধে ব্যবহার করতে পারে। সরকারি কর কার্যালয় ভৌগোলিক তথ্যের মাধ্যমে সক্ষম জনগোষ্ঠীর কর দেওয়া নিশ্চিত করতে পারে।

আজকে দক্ষিণ কোরিয়ার অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ও টেকসই উন্নয়ন কিন্তু সম্ভব হয়েছে গবেষণা ও জ্ঞানবিজ্ঞানে ব্যাপক বিনিয়োগের কারণে। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে অসুখ ধরতে না পারা। তাই সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিশৃঙ্খলা। হোক সেটা স্বাস্থ্য খাত, কিংবা অন্য কোনো খাত। গুণগত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য যে শুধু আমাদের দরকার তা নয়, আমরা এই খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বেসরকারি সংস্থা বিশ্বে ভৌগোলিক তথ্য বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। এ বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করা গেলে সামনের দিনগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যাবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভৌগোলিক তথ্য তৈরিতে জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জিওস্পেশিয়াল-ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। আমাদের দেশে এমন একটি সংস্থা সময়ের দাবি। এই সংস্থার কাজ হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্ভরযোগ্য ভৌগোলিক তথ্য তৈরিতে দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তদারক করা।

মনে রাখতে হবে, এই সংস্থা নিজে তথ্য তৈরি করবে না। এটির কাজ হতে পারে সংগ্রহ করা উপাত্তের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, দক্ষ ও পেশাদার জনবল তৈরি। এমনটা না করে গেলে আমরা হয়তো বড় দুটি নগরের জলাবদ্ধতা রোধে খাল ও নর্দমাকেন্দ্রিক পরিকল্পনাকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যাব, যার ফল নিশ্চিতভাবে ‘রাজনীতির চোরাবালি আর দোষারোপের সংস্কৃতি’। বোনাস হিসেবে প্রতি বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীর জন্য থাকবে ঘুমপাড়ানির মাসিপিসির গল্প।

লেখক: অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক