জাতিসংঘে বাংলাদেশ

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে ঠিক ৪৬ বছর আগে, এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি সেদিন গণতন্ত্র, ন্যায়পরায়ণতা, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরেছিলেন। জাতিসংঘের আদর্শ ও সনদের প্রতি বাংলাদেশের জোরালো অঙ্গীকারের কথা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ২২ বছর পর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাধারণ পরিষদে বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে দেওয়া সেই বক্তৃতায় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন।

জাতিসংঘের আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। এর মধ্যে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় শেখ হাসিনা সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনবার বাংলায় বক্তৃতা করেন। আর ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি এ পর্যন্ত আরও ১১ বার বাংলায় বক্তৃতা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সারা বিশ্বে উন্নয়ন নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন। সামগ্রিকভাবে তিনি ক্ষুধা ও পরমাণু অস্ত্রের শঙ্কামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এই লক্ষ্যে তিনি জাতিসংঘের আরও বলিষ্ঠ, কার্যকর, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেছিল জাতিসংঘ। উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা, দেশে দেশে বন্ধুতার বাতায়ন তৈরি আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ৭৫ বছরের যাত্রাপথে জাতিসংঘকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। ফলে যে স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ব সংস্থাটি যাত্রা করেছিল, সেই ভূমিকা কতটা পালন করতে পেরেছে আর পারেনি, সেই প্রশ্নও রয়েছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। এর পাঁচ বছরের মাথায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সদস্য নির্বাচিত হয়। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০০ ও ২০০১ সালে আবার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০০০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ। এর আগে ১৯৮৬ সালে সংস্থাটির সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের তখনকার স্থায়ী প্রতিনিধি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।

গত ৪৫ বছরে জাতিসংঘের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ও উদ্যোগের সামনে থেকেছে বাংলাদেশ। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক শক্তিশালী ও নিরাপত্তা পরিষদের কোনো কোনো স্থায়ী সদস্যও শুরুতে এসব উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। প্রস্তাবগুলো পাসের পর অবশ্য এসব দেশ উল্টো নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তায় নারীর ভূমিকার স্বীকৃতিসংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাব, ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ৫৪/১৯৪ নম্বর প্রস্তাব। এর পাশাপাশি জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) মতো সংস্থাগুলোর নির্বাহী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছে।

উচ্চ পদে বিশিষ্টজনেরা

জাতিসংঘ
ছবি: টুইটার

জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ যেমন নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে তেমনি বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্টজন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।

জাতিসংঘের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে প্রথম প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। সাবেক ওই কূটনীতিক ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়–বিষয়ক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশনের (এসকাপ) নির্বাহী সচিব নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালের মে থেকে ১৯৯২ সালের মার্চ অর্থাৎ প্রায় এক দশক তিনি এসকাপের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে কম্বোডিয়ায় মানবিক ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি আনোয়ারুল করিম চৌধুরী ২০০২ সালে সংস্থাটির আন্ডারসেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই বছরের মার্চে জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিব কফি আনান তাঁকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) উচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমেও বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু তৈয়ব মুহাম্মদ জহিরুল আলম লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন। অনেক বছর ধরেই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সদস্য মোতায়েনকারী শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘে প্রায় চার দশক ধরে কর্মরত ছিলেন বর্তমানে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ার আমিরা হক। তিনি ২০০৯ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম বিভাগ ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ড সাপোর্টের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে তিনি পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি, সুদান ও আফগানিস্তানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী এবং মালয়েশিয়া ও লাওসে জাতিসংঘের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন।

দুই দশকের ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে কাজ করে এসেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। এ বছরের শুরুতে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি বলেন, এই ২০ বছরে সারা পৃথিবী যেভাবে পাল্টে গেছে, বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকেনি। তাই জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভূমিকাও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।

পররাষ্ট্রসচিবের মতে, নানা সংকট ও সমস্যার পরও বাংলাদেশ বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল। কারণ, শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিপক্ষীয় দর–কষাকষিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয় না। এই ন্যায্যতা বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়াতেই নিশ্চিত করা যায়।