জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন দাখিল

জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাত ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার এটি দাখিল করা হয়।

তদন্ত সংস্থার ধানমন্ডির কার্যালয়ে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘তদন্তে আমরা প্রাথমিকভাবে জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে একাত্তরের নৃশংসতার জন্য অভিযুক্ত করেছি। এ জন্য আমরা তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও অবলুপ্তি চেয়েছি।’

তদন্ত সংস্থা জানায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সাতটি ধারায় জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অপরাধ এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। জামায়াতের পাশাপাশি একাত্তরে দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, শান্তি কমিটি (লিয়াজোঁ), রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী (অপারেশনস) এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার (প্রপাগান্ডা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত সংগঠনগুলোর নীতি, নীতিনির্ধারক, সংগঠক, পরিচালক ও সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী ওই সব অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী। এ জন্য তাঁদের বিচারের জন্য তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো।

তদন্ত সংস্থা জানায়, ৩৭৩ পৃষ্ঠার মূল তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রায় আড়াই হাজার পৃষ্ঠার জব্দ তালিকা ও দালিলিক নথি অভিযোগ প্রমাণের জন্য দাখিল করা হবে। এর সঙ্গে বিভিন্ন বই, গবেষণাপত্র ও নথি রয়েছে আরও সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার বেশি। অভিযোগ প্রমাণের জন্য ৭০ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি নবম জাতীয় সংসদে ট্রাইব্যুনালের আইনে ব্যক্তির পাশাপাশি দলের বিচারের বিধান যুক্ত করে সংশোধনী পাস হওয়ার পর ১৮ আগস্ট তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মতিউর রহমান। তিনি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটিও তদন্ত করেছিলেন।

তদন্ত সংস্থা জানায়, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন সাধারণত নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা অবলুপ্ত করা হয়। বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো কোনো রাজনৈতিক দলকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এর আগে ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নািস পার্টিসহ সাতটি সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল (নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল) সনদের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো গোষ্ঠী বা সংগঠনের সদস্যের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন। ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে যৌথ বাহিনী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২৪ জন ব্যক্তি এবং সাতটি সংগঠনকে অভিযুক্ত করে। সংগঠনগুলো হলো ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নািস পার্টি), হিটলারের মন্ত্রিসভা (রাইখ ক্যাবিনেট), এসএস, এসডি ও এসএ (নািস পার্টির অধীনে তিনটি আধা সামরিক বাহিনী), গেস্টাপো (গোপন পুলিশ বাহিনী) এবং জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব। বিচারে নািস পার্টিসহ চারটি সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হয় এবং নািস পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাকি সংগঠনগুলো এর আগেই অস্তিত্ব হারানোয় সেগুলো আর নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি।

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দলটি তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তত্কালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত। ইসলামী ছাত্রসংঘও নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর অস্তিত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে দলটির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম এখনো রয়েছে।