জাহাজের নগরী নেছারাবাদ

কম টাকায় ভালো মানের ট্রলার, বাল্কহেড, কার্গো, ড্রেজার নানা ধরনের ভারী নৌযান তৈরি করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ছুটে আসছে পিরোজপুরের নেছারাবাদে। এখানকার জাহাজনির্মাণ শিল্পটি সম্প্রতি বিকাশ লাভ করেছে। এখানে নদীতীরে গড়ে উঠেছে ২৫টি ডকইয়ার্ড।

৫০ লাখ টাকার ছোট নৌযান থেকে শুরু করে ১০ কোটি টাকার বড় কার্গো জাহাজ তৈরি হচ্ছে নেছারাবাদেছবি: প্রথম আলো

দেশে জাহাজনির্মাণের অন্যতম পীঠস্থান হওয়ার পথে এখন পিরোজপুরের নেছারাবাদ। কম টাকায় ভালো মানের ট্রলার, বাল্কহেড, কার্গো, নদী খননযন্ত্রসহ (ড্রেজার) নানা ধরনের ভারী নৌযান তৈরি করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ছুটে আসছে নেছারাবাদে। এভাবে চাহিদা বাড়তে থাকায়, অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবেই এই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নদীতীরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ২৫টি ডকইয়ার্ড। বছরে এসব ডকইয়ার্ডে বর্তমানে ২০০টি ভারী নৌযান তৈরি করা হয়। মেরামত হচ্ছে আরও দেড় থেকে দুই হাজার নৌযান।

৫০ লাখ টাকার ছোট নৌযান থেকে শুরু করে এখানে ১০ কোটি টাকার বিশাল কার্গো জাহাজ তৈরি হচ্ছে বর্তমানে। উপজেলায় এ শিল্পকে ঘিরে বছরে ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় সাত হাজার মানুষের। এসব ডকইয়ার্ডে সারা বছর ধরে নৌযান তৈরি ও মেরামতের কাজ হয়। এখানকার নৌযান নির্মাণশিল্পে যুক্ত মালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উন্নতমানের জাহাজ নির্মাণ করে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন তাঁরা।

নেছারাবাদে অনেক কম টাকায় ভালো মানের জাহাজ তৈরি করা যায়, এ কথা এখন সবার জানা। এর কারণ, এখানকার ডকইয়ার্ডের জমির দাম অত্যন্ত কম। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিকদের অনেক কম মজুরি। কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা এই জাহাজনির্মাণ শিল্প এক অবাক বিস্ময়ই বটে। নদীপথকে কেন্দ্র করে এ উপজেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আঠারো শতক থেকে চলে এলেও, জাহাজনির্মাণ শিল্পটি বিকাশ লাভ করেছে সম্প্রতি। এখানকার শ্রমিকদের অনেক কষ্ট করে কাজ করে যেতে হচ্ছে। তাঁদের যেমন নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা, তেমনি খাটুনিও অনেক বেশি। ক্রমবিকাশমান এই জাহাজনির্মাণ শিল্পের তাই সম্ভাবনার মধ্যে এ যেন বড় এক সংকটও।

শুরুটা যেভাবে

সর্পিলাকার সন্ধ্যা নদী, তারই তীরে নেছারাবাদ উপজেলা। সন্ধ্যা নদীর দুই তীরে দেড় শ বছর আগে থেকে গড়ে ওঠে নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে সন্ধ্যার তীরের প্রসিদ্ধ ভাসমান কাঠের বাজার এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই এ উপজেলার ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনের কাঠের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখন বড় বড় কাঠের নৌকায় সুন্দরবন থেকে কাঠ ও গোলপাতা পরিবহন করা হতো। ধীরে ধীরে কাঠের নৌকার পাশাপাশি ইঞ্জিনচালিত স্টিলের ট্রলার ব্যবহার শুরু হয়। এসব ট্রলার মেরামত ও নির্মাণের জন্য গড়ে ওঠে ছোট ছোট ডকইয়ার্ড।

পরবর্তী সময়ে সন্ধ্যা নদী ঘিরে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। নৌপথে পণ্য ও মালামাল পরিবহনের জন্য নৌকা হয়ে ওঠে প্রধান বাহক। চাহিদার কারণে ডকইয়ার্ডগুলোতে প্রথমে ট্রলার তৈরি করা হতো। শুরুতে ট্রলার দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ডকইয়ার্ডগুলোতে ২০০ থেকে ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের কার্গো তৈরি হচ্ছে, যার ধারণক্ষমতা দুই হাজার টন থেকে আড়াই হাজার টন।

উপজেলার সোহাগদল গ্রামের কার্গোর মালিক আবু সালেহ বলেন, চার দশক আগে উপজেলার সুটিয়াকাঠি গ্রামের আমজাদ হোসেন কাঠের তৈরি ইঞ্জিনচালিত নৌযান নিয়ে আসেন। আমজাদ হোসেনের দেখাদেখি অনেকেই ইঞ্জিনচালিত নৌযান কেনেন। দিন দিন ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্রলারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযান মেরামতের জন্য গড়ে তোলা হয় ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডে প্রথমে কাঠের তৈরি ট্রলার তৈরি ও মেরামত করা হতো। ৩৫ বছর আগে উপজেলার বরছাকাঠি গ্রামের আবদুল বারেক ও রুস্তম আলী ঢাকা থেকে স্টিলের তৈরি ট্রলার নিয়ে আসেন। এর কয়েক বছর পর ডকইয়ার্ডে স্টিলের ট্রলার তৈরি ও মেরামতের কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় ডকইয়ার্ডের ভাড়া কম ও নৌযান নির্মাণশ্রমিকদের পারিশ্রমিক কম হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে নৌযান তৈরি করতে আসতে থাকেন।

সন্ধ্যা নদীর দুই পাড়ের গ্রাম ছারছিনা, নান্দুহার, কালীবাড়ি, বালিহারী, মাগুরা গ্রামে ছোট-বড় ২৫টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। বছরে এসব ডকইয়ার্ডে ২০০টি নৌযান তৈরি করা হয়। মেরামত করা হয় দেড় থেকে দুই হাজার নৌযান। ২০০ থেকে ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বড় আকারের নৌযান তৈরিতে সময় লাগে ৯-১০ মাস। মাঝারি আকারের ১০০ থেকে ১৫০ ফুটের নৌযান তৈরি করতে ৫-৬ মাস লাগে।

জাহাজনির্মাণ শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে ওয়ার্কশপ, হার্ডওয়্যার, স্টিলের পাত, ওয়েল্ডিং রড, রঙের দোকানসহ নানা ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ডকইয়ার্ডের মালিকেরা বলেন, জাহাজনির্মাণের কাঁচামাল আনা হয় ঢাকার পোস্তগোলা, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী ও সীতাকুণ্ড থেকে। এ ছাড়া কিছু কাঁচামাল বিদেশ থেকেও আমদানি করা হয়ে থাকে।

স্থানীয় শ্রমিক নাসির হাওলাদার (৩৫) বলেন, একসময়ে ডকইয়ার্ডে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দক্ষ শ্রমিক এনে কাজ করানো হতো। স্থানীয় ব্যক্তিরা ডকইয়ার্ডে কাজ শিখে এখানেই কাজ করছেন। এখন ডকইয়ার্ডের অধিকাংশ শ্রমিক স্থানীয়।

তবে শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, কাটিং বা ওয়েল্ডিং করার সময় সৃষ্ট আগুন শ্রমিকদের গায়ে ও মাথায় পড়ে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায়, তাঁরা কষ্টে কাজগুলো করেন। কামরুল ইসলাম নামের একজন শ্রমিক বলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তার অনেক অভাব। হেলমেট নেই, হাতের গ্লাভস নেই। দৈনিক মজুরি কম।’

নাটোরের আমিরুল ইসলাম নৌযান নির্মাণের একজন ঠিকাদার। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নেছারাবাদের ডকইয়ার্ডগুলোতে কার্গো, বাল্কহেড ও ট্রলার তৈরি করার জন্য ব্যবসায়ীরা আসেন। এখানের ডকইয়ার্ড ভাড়া ও শ্রমিকদের মজুরি অন্য এলাকার চেয়ে কম হওয়ায় নৌযান নির্মাণের খরচ তুলনামূলকভাবে কম লাগে। একজন দক্ষ শ্রমিক প্রতিদিন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা এবং সাধারণ শ্রমিকেরা ৩২০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান।

দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

উপজেলার ছারছিনা গ্রামের সালেহিয়া ডকইয়ার্ডের মালিক আবদুল গফফার মৃধা বলেন, একসময় ডকইয়ার্ডে ট্রলারসহ ছোট নৌযান তৈরি হতো। কয়েক বছর ধরে বড় ধরনের কার্গো তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা এখানে আসছেন। তবে বড় নৌযান তৈরি জন্য ডকইয়ার্ড আধুনিকায়ন করা দরকার। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘এখানের ডকইয়ার্ডগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে। সমন্বিত ডকইয়ার্ড করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের জন্য মালিকদের চাহিদা নেই। তবে আমরা নিজেরা ভাবছি, প্রশিক্ষিত ডকশ্রমিক হলে তাঁরা আরও ভালো কাজ করবেন। আমরা এ শিল্পকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য চেষ্টা করছি। ডকইর্য়াডগুলো আরও উন্নত করার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ডকইর্য়াডগুলোতে নৌযান তৈরি ও মেরামত করে বছরে কয়েক শ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। এতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।’

স্থানীয় স্বরূপকাঠি পৌরসভার মেয়র মো. গোলাম কবির বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো শিল্প ছিল না। তবে নৌযান নির্মাণের মধ্য দিয়ে এখানে সম্ভাবনাময় জাহাজশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আমরা এ শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’