জাহানারার মনে ছিল জেদ

নার্সারিতে ১৫ টাকা থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা দামের চারা আছে। সেই হিসাবে এখন জাহানারা বেগমের নার্সারিতে ১৫ লাখ টাকার চারা আছে।

নার্সারির পরিচর্যা করেই সময় কাটে জাহানারা বেগমের। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন্দ গ্রামেছবি: প্রথম আলো

জাহানারা বেগমের (৪৫) প্রবল ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া করবেন। স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার পর সংসারের টানাপোড়েনে আর এগোতে পারেননি। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি-দুই জায়গাতেই অভাব ছিল। তবে জাহানারার মনে জেদ ছিল। নিজে পারেননি কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে নার্সারি করেছেন। তিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন, পেয়েছেন জয়িতার সম্মান।

জাহানারা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন্দ গ্রামে। স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার তাঁর। সম্প্রতি দেখা যায়, তিন একর জমির ওপর জাহানারার বাড়ি। বসত ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোন। এর বাইরে পুরোটাই গাছগাছালিতে ভরা। আম, জাম, কাঁঠাল, কমলা, লিচু, পেঁপে, পেয়ারা, নারকেল, সুপারি, আতাফল, কামরাঙা, জলপাই, জাম্বুরাসহ বেশির ভাগই ফলের গাছ। এবার সবুজ মাল্টার চারাও করেছেন। বগুড়া থেকে এনেছেন বিভিন্ন জাতের আমের চারা। এর মধ্যে হারিভাঙা, হিমসাগর, আম্রপালি রয়েছে।

আলাপকালে জাহানারা বলেন, মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে ১০ জনের সংসার ছিল তাঁদের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। একবেলা দুমুঠো খেলে, দুবেলা উপোস থাকতে হতো। ছোটবেলার সেই কষ্ট এখনো মনে গেঁথে আছে তাঁর। অনাদর-অবহেলা ছিল নিত্যদিনে সঙ্গী। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর জমি-জিরাত নেই। কৃষিকাজ করে টেনেটুনে সংসার চলে। এর মধ্যে তাদের দুই সন্তান হয়। ভাবতেন, সংসারের গরিবি দশা দূর করতে কিছু একটা করতেই হবে।

২০০৬ সালে তাঁদের বড় ছেলে বেলাল হোসেন পাঠশালা পাস করে। তাকে পড়াশোনা করাতে খরচ লাগবে। টাকা পাবেন কোথায়? এর মধ্যে একদিন শোনেন, গ্রামের নারীরা মিলে একটি সমিতি করেছেন। তিনিও সদস্য হন। কিছুদিন পর উপজেলায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ডাক আসে। নার্সারি বিষয়ে তিন দিনের প্রশিক্ষণ নেন। এর আগে উপজেলা তো দূরের কথা, গ্রামের বাইরে কখনো পা পড়েনি তাঁর। টাকা পয়সা নেই। ওই সময় প্রতিদিন ১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। বাড়িতে কিছু মরিচ ও পেঁপের বীজ ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে সেগুলো দিয়ে চারা করার কাজ শুরু করেন। তারপর চার হাজার টাকা ঋণ নেন। দিনরাত কাজ করেন।

জাহানারা আরও বলেন, প্রথম দিন একটি ঝুড়িতে ৫০টি চারা দিয়ে স্বামী হাসান আলীকে সেগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে বললেন। প্রথমে হাসান রাজি হননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাসান বাজারে গেলেন এবং বাড়ি ফিরে জানালেন সব চারা মানুষ হাতে-হাতেই কিনে নিয়েছে। ছয় মাস পর ঋণ শোধ করেন। এরপর আয় থাকে আরও ১০ হাজার টাকা। এরপর আর থামতে হয়নি। কোনো ঋণও নিতে হয়নি। প্রতি বছর আয় থেকে নার্সারি বড় হয়। এখন মানুষ বাড়ি থেকে এসে চারা নিয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী মিলে নার্সারির পরিচর্চা করেন। এ ছাড়া আরও তিনজন লোক রাখেন কাজের জন্য।

তাঁদের নার্সারিতে এখন ৬০ হাজারের মতো চারা আছে। বছরে তিন লাখের মতো চারা উৎপাদন করেন তাঁরা। পাইকারি এবং খুচরা দুই ভাবেই চারা বিক্রি করেন। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আগে থেকে চারার অর্ডার দিয়ে রাখে। আবার কেউ কেউ এক লাখ, দেড় লাখ টাকার চারাও কিনে নেয়। নার্সারিতে ১৫ টাকা থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা দামের চারা আছে। সেই হিসাবে এখন তাঁদের নার্সারিতে ১৫ লাখ টাকার চারা আছে। এক সময় ছোট্ট শণের ঘর ছিল, এখন টিনের ঘর বানিয়েছেন। ঘরে বিদ্যুৎ এনেছেন। অন্যের কাছে কিছু জমি বন্ধক ছিল সেগুলো ছাড়িয়েছেন। সবই হচ্ছে নার্সারির আয় থেকে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৯ সাল থেকে মাছ চাষ শুরু করেছেন। বাড়িতে দুটি পুকুর আছে। মাছ চাষে বছরে আয় হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। উন্নত জাতের একটি গরুর খামার করার চিন্তা আছে তাঁর।

পরিবারের সদস্যরা বলেন, ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের (এলজিইডি) পক্ষ থেকে জাহানারাকে অর্থনৈতিকভাবে সফল নারীর পুরস্কার দেওয়া হয়। তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। নিজের এই সাফল্য নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগেননি জাহানারা। সমাজের জন্যও কাজ করছেন। গ্রামের ৩০ জন নারী মিলে ‘এসো কাজ করি’ নামের একটি সংগঠন করেছেন। সংগঠনের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করেন। মেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগান।

জাহানারা বেগম বলেন, ‘নিজের জীবন থেকে দেখেছি, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলে সংসারে দাম পাওয়া যায় না। নারীদের লেখাপড়া করতে হবে। একজন শিক্ষিত নারী একটি পরিবারকে বদলে দিতে পরে। আমি চাই, প্রত্যেক নারী যেন স্বাবলম্বী হয়, পরিবারে ও সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচতে শেখে।’