জীবন দিয়ে চিহ্ন রেখেছে হালতি

নাটোরের হালতি বিল এখন পর্যটকদের কাছে পরিচিত ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে। ব্রিটিশ আমলে এ বিলে ডানা মেলত রংচঙা হালতি পাখি।

পাটুল ঘাটে বাঁধা থাকে সারি সারি নৌকা। কতটা গ্রাম ঘুরবেন, সে অনুযায়ী নৌকার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়ছবি: প্রথম আলো

গ্রীষ্মের পরিযায়ী পাখি ‘হালতি’ একসময় দল বেঁধে উড়ে বেড়াত নাটোরের বিলের বুকে। প্রচলিত আছে, এখনকার নাটোর শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরের সে এলাকায় পাখি শিকারে যেতেন ব্রিটিশ আমলের কর্মকর্তারা। শৌখিন এই শিকারিদের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ যেত হালতি পাখিদের।

পরে স্থানীয় লোকজনের কাছে এই পাখির নামেই বিল পরিচিতি পায় হালতি বিল নামে। এখনকার পর্যটকদের কাছে এই বিল ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবেও পরিচিত। অথচ দুই যুগ আগেও হালতি বিল অভিশপ্ত বিল হিসেবে পরিচিত ছিল। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় চুরি–ডাকাতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

নাটোর শহরের অদূরের এ বিলের জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে খোলাবাড়িয়া, নুরিয়াগাছা, ভূষণগাছা, একডালা কুচকুড়ি, বিলহালতি, দিঘিরপাড়, করেরগ্রাম, মদনডাঙ্গা ও খাজুরা নামের কয়েকটি গ্রাম। একসময় এসব গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষ আর বর্ষায় মাছ শিকার। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে গ্রামের বাসিন্দাদের চলতে হতো হেঁটে। ২০০৪ সালে এ বিলের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করা হয় ডুবোসড়ক। বর্ষায় সড়কটি ডুবে থাকে। তবে শুষ্ক মৌসুমে সড়কটি গ্রামগুলোর সেতুবন্ধন রচনা করে। এ সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে গ্রামগুলোর পুরোনো চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। শুষ্ক মৌসুমে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এ সড়ক ধরে গ্রামবাসী শহরে চলাচল করতে শুরু করেন।

এখন বর্ষার শুরু ও শেষ সময়ে ডুবোসড়ক দেখতে শহর থেকে মানুষের যাতায়াত বাড়ে। একই সঙ্গে বিলের পানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় ঘুরে বেড়ান কেউ কেউ। বর্ষায় হালতি বিলের গভীরতা দাঁড়ায় ১২ মিটার পর্যন্ত। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে এলেও একবারে শুকিয়ে যায় না। ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এ বিলের কথা ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বর্ষায় দল বেঁধে ঘুরতে আসেন হাজারো পর্যটক।

পর্যটনকে ঘিরে বিলের বিচ্ছিন্ন গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে। বিলের বুক চিরে প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। শুধু কৃষিকাজ ও মাছ না ধরে গ্রামের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যুবক পাড়ি জমিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাঁদের উপার্জিত অর্থে গ্রামের অনেকেই নাটোর শহরে বাড়ি ও দোকানপাট গড়েছেন। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর এখন পাকা। কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘জিরো পয়েন্ট’।

বিলের জলরাশির মধ্যে দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গ্রাম
প্রথম আলো

নাটোর শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হালতি বিলের অবস্থান। শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে অটোরিকশায় ২০ থেকে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে হালতি বিলের প্রবেশপথ পাটুল ঘাটে পৌঁছানো যায়। এ ছাড়া নলডাঙ্গা উপজেলা সদর থেকেও ১৫ থেকে ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ভ্যান, অটোরিকশা ও ভটভটিতে পাটুল ঘাটে যাওয়া যায়। এ ঘাটে বাঁধা থাকে সারি সারি নৌকা। কতটা গ্রাম ঘুরবেন, সে অনুযায়ী নৌকার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কেউ ঘণ্টার চুক্তিতেও নৌকা ভাড়া করেন।

জানুয়ারি থেকে বিলের চিত্র পাল্টাতে শুরু করে। পানি কমে জেগে ওঠা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন কৃষকেরা। ফেব্রুয়ারির দিকে বিলজুড়ে ধানগাছকে মনে হয় সবুজের গালিচা।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, যাঁরা অল্প সময় হাতে নিয়ে আশপাশ থেকে ঘুরে আসতে চান, তাঁদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে হালতি বিল। ডুবন্ত সড়কের কারণে বিলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে সমুদ্রসৈকতের আবহ মেলে। পর্যটকেরাও এসে উপভোগ করেন এমন পরিবেশ।