জীবনকে যেন আরও উঁচুতে নিতে পারি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ফাইল ছবি

আমাদের জীবনে সুখ থাকে, দুঃখ থাকে। সুখ-দুঃখের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে। যার ফলে আমরা প্রায়ই বলি, মোটামুটিভাবে ভালো গেল এ বছরটা। কিন্তু ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমরা এই ভারসাম্যটাকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি। ফলে আমাদের দুঃখ-কষ্টের পরিমাণ বেড়েছে, হতাশা আমাদের জীবনের দখল নিয়েছে।

স্বজন হারানো, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আমরা হেজে গেছি। যাঁদের হারালাম, তাঁরা তো হারিয়েই গেলেন। যাঁরা রয়ে গেলেন, তাঁদেরও মানসিক কষ্ট এবং উৎকণ্ঠার অবধি নেই। একটা ভারী দুঃখ পৃথিবীর মানুষকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে।

আগের যুগে যে অসুখ-বিসুখ হতো, সেগুলো হতো আঞ্চলিক। বিংশ শতাব্দীতে স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল, তাতে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল, পাঁচ কোটির মতো। সেটাও কিছু কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যায়ন আর বিশ্বায়নের কারণে সারা পৃথিবী আজ একটিমাত্র দেশে পরিণত হয়েছে। এর সুফলগুলোও আমরা পাচ্ছি। সারা পৃথিবীর সব বিচিত্র ও কাম্য জিনিসগুলোকে আমরা যে রকম উপভোগ করতে পারছি, অতীতে তা পারিনি। সেই সঙ্গে আবার সারা পৃথিবীর রোগ-শোক, দুর্দশা-দুর্দৈব বৈশ্বিক হয়ে গেছে।

আমরা জানি, গ্রিক শাসক পেরিক্লিস প্লেগে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় প্লেগ এথেন্স শহরকেন্দ্রিক ছিল। নিশ্চয়ই আরও অনেক শহরে তখন প্লেগ ছিল। ৫৮১ সালে ইউরোপে একটা প্লেগ হয়েছিল, যাতে ২০ কোটি লোকের মধ্যে ১০ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। এ রকম ভয়াবহ ঘটনাও ঘটেছে। এখন বিশ্ব এক হয়ে গেছে। সেই যুগ যদি থাকত, তাহলে আজকের পৃথিবীর ৮০০ কোটি লোকের মধ্যে আমরা হয়তো অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ লোককে হারিয়ে ফেলতাম।

কিন্তু ইতিমধ্যে মানবসভ্যতার বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এর নিরন্তর গবেষণা অনেক এগিয়ে নিয়েছে পৃথিবীকে। যার ফলে মানুষের মধ্যে একটা আশার দিকও জেগেছে।

আমাদের খুবই দুঃখের একটা বছর গেল। খুবই বেদনার, আতঙ্কের এবং হতাশার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সভ্যতার অগ্রযাত্রা এই পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে না। চাণক্য লিখেছিলেন, শত্রু অদৃশ্য হলে অদৃশ্য হয়েই তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ আমাদের তা শিখিয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞান জেনে ফেলেছে, এই নতুন জাতের মারাত্মক ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে, আর মারা যায় সামান্য একটা জিনিস গায়ে লাগলে—এর নাম সাবান। সুতরাং যে হাতের মাধ্যমে নানা জায়গা থেকে এই ভাইরাস আমাদের শরীরে আসছে, আমরা সাবান দিয়ে সে হাত যদি ঘন ঘন ধুয়ে ফেলি আর হাতকে কিছুতেই মুখের সঙ্গে না লাগতে দিই, তবে এর সংক্রমণের হাত থেকে আমরা বেঁচে যেতে পারি। আরেকটা ছোট্ট কথা। এই রোগ যেহেতু মানুষের হাঁচি-কাশি আর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ছড়ায়, তাই ঘরের বাইরে সবাই মাস্ক পরে থাকলে এ রোগের হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

প্রাণিজগতের দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন আমরা দেখি, প্রতিটি প্রাণীরই কিছু না কিছু আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র আছে। কারও ভয়াবহ নখ আছে, কারও আছে বড় দাঁত, কারও শিং আছে, কারও গায়ে কাঁটা। নিজেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা সব প্রাণীরই আছে। কিন্তু মানুষ জন্মায় সম্পূর্ণ অর‌ক্ষিত অবস্থায়। এত অসহায় যে অন্তত দুটো বছর তাকে কোলের মধ্যে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখে মানুষ করতে হয়।

কথাগুলো ছোট। কিন্তু আমরা যেন না ভুলি, এই ছোট্ট কথাগুলো আবিষ্কার করার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মানবজাতির হাজার হাজার বছরের বিজ্ঞানসাধনার ইতিহাস—অসংখ্য বৈজ্ঞানিকের অগণিত বিনিদ্র রাত আর অবিশ্রান্ত শ্রমের এক অবিশ্বাস্য মহাকাব্য।

মানবজাতির এই সাধনার পথ ধরে এবার এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বের হয়েছে ভাইরাসের ভ্যাকসিন, যা আগে অনেক দীর্ঘ সময় নিত। এর চিকিৎসা বের হওয়ার চেষ্টাও চলছে এবং ইতিমধ্যে এর মোটামুটি ব্যবস্থাপনা বেরিয়েছে। আগে যখন মহামারি হতো, তখন বছরের পর বছর তা চলত। এখন সেই রোগটাকে বছরখানেকের মধ্যে সীমিত করে আনা গেছে বলেই মনে হচ্ছে।

ভ্যাকসিন এসে গেছে, চিকিৎসা এসে যাচ্ছে, আমরা আবার হয়তো মুক্ত হব। আনন্দিত হব। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। প্রাণিজগতের দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন আমরা দেখি, প্রতিটি প্রাণীরই কিছু না কিছু আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র আছে। কারও ভয়াবহ নখ আছে, কারও আছে বড় দাঁত, কারও শিং আছে, কারও গায়ে কাঁটা। নিজেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা সব প্রাণীরই আছে। কিন্তু মানুষ জন্মায় সম্পূর্ণ অর‌ক্ষিত অবস্থায়। এত অসহায় যে অন্তত দুটো বছর তাকে কোলের মধ্যে সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখে মানুষ করতে হয়।

এত অসহায় যে মানুষ, সেই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হয়েছে কী করে? মানুষ শক্তিশালী হয়েছে সহযোগিতা দিয়ে, পরস্পরকে ভালোবাসা দিয়ে, পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে, প্রেম দিয়ে, সাহায্য করে। মানুষ পরস্পরকে সাহায্য করে পরস্পরের দুঃখে এগিয়ে যায়। তাই তো মানবজাতি বেঁচে আছে, বড় হয়েছে।

এই অসুখটা একদিক থেকে একটা ভয়ংকর অসুখ, এটা মানুষ মানুষের চিরকালের সম্পর্ককে ভেঙে দিয়েছে। মানুষকে মানুষের দুঃখে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রোগটা বন্ধু বা প্রিয়জনের কাছ থেকে আমাদের দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছে। এই রোগ পিতামাতা থেকে সন্তানকে, ভাই থেকে ভাইকে, বন্ধু থেকে বন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। প্রতিটি প্রিয়জন আজ আমাদের শত্রু, প্রতিটি মানুষ সন্দেহজনক ও পরিত্যাজ্য। একা ঘরে রোগে ভুগে নিঃসঙ্গভাবে মানুষকে মরে যেতে হচ্ছে। সে নিঃসঙ্গ, তার চারপাশের মানুষেরা নিঃসঙ্গ। কেউ কারও কাছে যেতে পারছে না। মৃত্যুও হচ্ছে নিঃসঙ্গভাবে, প্রার্থনাহীনভাবে। তার কবর হচ্ছে নিঃসঙ্গভাবে। মৃত্যুরও একধরনের মহিমা আছে, একটা মৃত্যুতে কত মানুষ একত্র হয়, কত মানুষের শুভেচ্ছা মৃত্যুর সঙ্গে যায়। ড. আনিসুজ্জামান মারা গেলেন। কত বড় একজন মানুষ। আমরা শুধু ঘরে বসে খবরটা শুনলাম। আর কিছুই করতে পারলাম না।

এর থেকে যদি আমরা মুক্তি পাই, তাহলে আমরা একটা শিক্ষা নিয়ে মুক্তি পাচ্ছি। সেই শিক্ষা হলো, একটা সুন্দর পৃথিবী আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কারণ, আমাদের ধারণা, সচেতনতা শুধু মানুষের মধ্যে আছে, এটা কিন্তু সত্য নয়। সারা বিশ্বচরাচরে সবখানে সবকিছুর মধ্যে সচেতনতা আছে। প্রকৃতির মধ্যেও আছে।

এমন অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও আমরা প্রায় জয়ী হতে চলেছি। আমি মনে করি যে এটা মানবজাতির জন্য একটা বিরাট সুসংবাদ। মানবজাতির যোগ্যতার একটা অত্যন্ত বড় প্রমাণ। ভ্যাকসিন এলে আশা করি আমাদের আগামী বছর সত্যিকারভাবে সফল হবে। তখন আবার আমরা হাসতে পারব, আনন্দ করতে পারব, উৎসব করতে পারব, একসঙ্গে হয়ে জীবনকে উদ্‌যাপন করতে পারব। গলাগলি করে হাঁটতে পারব। বুকে বুক মিলিয়ে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারব। আগামী বছর সেটা হোক, এই শুভকামনা করছি।

গত এক বছরে সারা পৃথিবীর মানুষের কর্মজগৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা মানুষের যে দায়িত্ব ও কাজ, সেটা আমরা করতে পারিনি। পৃথিবীর বহু জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে, বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে, দরিদ্র হয়ে গেছে। এই রোগটা যদি আর ১০টি বছর চলত তাহলে হয়তো সারা পৃথিবী প্রাগৈতিহাসিক যুগের কাছাকাছি চলে যেত। অর্থনৈতিকভাবে বা অন্যান্যভাবে।

এর থেকে যদি আমরা মুক্তি পাই, তাহলে আমরা একটা শিক্ষা নিয়ে মুক্তি পাচ্ছি। সেই শিক্ষা হলো, একটা সুন্দর পৃথিবী আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কারণ, আমাদের ধারণা, সচেতনতা শুধু মানুষের মধ্যে আছে, এটা কিন্তু সত্য নয়। সারা বিশ্বচরাচরে সবখানে সবকিছুর মধ্যে সচেতনতা আছে। প্রকৃতির মধ্যেও আছে।

অনেক সময় আমরা বলি ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। কেন বলি? কারণ, প্রকৃতির মধ্যেও তার নিজের ধরনে একটা বোধক্ষমতা আছে। তার ওপর বেশি আক্রমণ করলে সেও তার পাল্টা জবাব দেয়। এই সব শিক্ষা থেকে আমরা যেন প্রকৃতিকে ভালোবাসি, প্রকৃতিকে রুগ্‌ণতা থেকে মুক্তি দিয়ে উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে তুলি। আমরা প্রকৃতির সন্তান। যদি প্রকৃতি রুগ্‌ণ হয়ে যায় তাহলে আমাদের রুগ্‌ণতাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

জীবনের যে মূল্য কতখানি, আমরা এবার অনেকখানি বুঝেছি। নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের দুঃখ বুঝেছি। একটা বড় ধরনের আত্ম-আবিষ্কার অনেকেরই ঘটেছে। সেই জীবনকে যেন আমরা আরও উচ্চতরভাবে ব্যবহার করতে পারি, এটা হোক আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন।