জীবনজুড়েই সংস্কৃতির অঙ্গনে ছিল তাঁর পদচারণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম গতকাল ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। নজরুল গবেষক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

রফিকুল ইসলাম: জন্ম ১৯৩৪, মৃত্যু ২০২১

ভেবেছিলাম মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, আর কেউ শিগগিরই এতে যোগ দেবেন না। তা হলো না, আমাদের ছেড়ে সে মিছিলে গেলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। চলে যাওয়া পরিণত বয়সেই, তবু সে চলে যাওয়া সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি করে তার বেদনা শিগগিরই ভোলা যায় না।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্ম ঢাকার বাইরে চাঁদপুরে। কিন্তু কৈশোর থেকেই তিনি ঢাকার রমনার বাসিন্দা। আসাম-বাংলার রাজধানী করার জন্য পুরান ঢাকার নবাবপুর রেলগেটের অপর পারে গড়ে তোলা হয়েছিল মনোরম রমনা অঞ্চল। এখনকার মেডিকেল কলেজ, পুরোনো হাইকোর্ট ইত্যাদির সঙ্গে প্রাঙ্গণঘেরা ছোট ছোট বহু দোতলা লাল বাড়ি। বঙ্গভঙ্গ-রদের পরে এর বড় অংশই পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গুলিস্তান থেকে ফুলবাড়িয়া স্টেশনের আশপাশে কিছু বাড়ি বরাদ্দ হলো রেল কর্মকর্তাদের জন্য। তার একটি রেলওয়ে হাসপাতাল। রফিকুল ইসলামের পিতার কর্মস্থল ছিল ওই হাসপাতালে, আবাস হাসপাতালের পাশেই। স্কুল শুরু সেন্ট গ্রেগরিতে। বারবার দাঙ্গায় স্কুল বদলে বাংলা মাধ্যমে। পরে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ ও গ্র্যাজুয়েশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলায় এমএ। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরীর মতো কিংবদন্তিদের।

কৈশোর থেকে রফিকুল ইসলাম বেড়ে উঠেছেন ঢাকা শহরের সঙ্গে সঙ্গে। শহরও বেড়ে উঠেছে রমনাকে কেন্দ্র করে এবং ক্রমেই রমনাকে ছাড়িয়ে। কিশোর থেকে যুবক ও প্রৌঢ় রফিকুল ইসলাম দেখেছেন ঢাকা শহরের বেড়ে ওঠা। অবিভক্ত বাংলার ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জীবন। এ শুধু দালানকোঠার বেড়ে ওঠা নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি বিকাশের ধারাটিও। যুবক রফিকুল ইসলামের দেখা শুরু ঝাঁকড়া চুলের যুবক হিসেবে, হাতে গিটার। প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ হয়েছেন সেই পরিবর্তন অবলোকনের মধ্যে। কিন্তু কী আশ্চর্য! বার্ধক্য তাঁর চালচলন বা চিন্তায় কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। সব সময় থেকেছেন সমকালীন, হালনাগাদ।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় মিছিলে ছিলেন না খুব, ছিলেন ক্যামেরা হাতে। ভাষা আন্দোলনের যেসব ছবি এখন আমাদের নিত্যপরিচিত, এর বড় অংশই তাঁর ক্যামেরার কাজ। সংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর পদচারণা জীবনজুড়েই। পঞ্চাশের দশকের বুলবুল একাডেমি কিংবা ষাটের দশকের ঐকতান—ঢাকার প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। ১৯৬০-এর দশকে যখন আইয়ুব শাসনে ‘হিন্দু’ লেখকদের রচনা পাঠের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তখন ঐকতান ঢাকায় পালন করেছিল পাঁচ মহাকবি উৎসব—মধুসূদন আর রবীন্দ্রনাথও এঁদের মধ্যে ছিলেন। আরও আগে রবীন্দ্র-বর্জনের সরকারি চেষ্টার প্রতিবাদে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর।

শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। সে সময় বিভাগের তিনজন তরুণ শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সব নতুন উদ্যোগের মূল কর্মী। আবদুল হাই বের করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা পত্রিকা সাহিত্য পত্রিকা। তার মূল সহায়ক রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান। ১৯৬৩ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’। তাতে প্রধান কর্মী তাঁরাই। বাংলা বিভাগের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা বনভোজনের মতো উদ্যোগে রফিকুল ইসলাম সর্বদা আগ্রহী-পুরুষ। বিভাগের অ্যালামনাইয়ের কর্মকাণ্ডে বয়সের ভার অগ্রাহ্য করে সারা দিন থাকতেন ছাত্রদের সঙ্গে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নিয়েছিলেন ভাষাতত্ত্বে। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের আগ্রহে মুনীর চৌধুরী, কাজী দীন মুহম্মদ, রফিকুল ইসলাম—তিনজনই ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তাঁরাই বাংলাদেশে আধুনিক ভাষাতত্ত্ব-চর্চার সূচনা করেন। মোহাম্মদ আবদুল হাইয়ের তত্ত্বাবধানে নজরুলের ওপর পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন তিনি। নজরুল নির্দেশিকা এ কাজের গৌরচন্দ্রিকা, পরে ডিগ্রি পান ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও কবিতা’ অভিসন্দর্ভের জন্য (১৯৭৬)। রফিকুল ইসলামের গবেষণা ও প্রকাশনার একটি বড় অংশ নজরুল জীবন ও সৃষ্টিভিত্তিক। অন্য প্রকাশনার মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, ভাষা আন্দোলনসহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিবৃত্ত। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতিতও হয়েছেন। ভাষাতত্ত্ব নিয়েও একাধিক পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি।

সারা জীবন নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগের বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর ‘অ্যালমা ম্যাটার’। বাংলা একাডেমির প্রতি তাঁর বিশেষ মমতার পরিচয় রয়েছে ষাটোর্ধ্ব বয়সে এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণে; মৃত্যুকালে ছিলেন এর সভাপতি। নজরুল ইনস্টিটিউটের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘ সময়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। দেশের অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি পুরোধা ব্যক্তি; প্রথমে উপ-উপাচার্য, পরে উপাচার্য। জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মানটিও পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষের বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির পদও বিরল সম্মানের।

স্ত্রী জাহানারা চাটগাঁর চুনোতির এক সম্ভ্রান্ত সাংস্কৃতিক পরিবারের মানুষ। তাঁর অন্য দুই বোনের স্বামী মোতাহের হোসেন চৌধুরী ও মাহবুবুল আলম চৌধুরী। ছেলে বর্ষণ, মেয়ে মেঘলা।

পরিবার-পরিজন, ছাত্র-সহকর্মী-বন্ধুবান্ধব, সমাজ-সংস্কৃতি, ভাষণ-রচনা-প্রকাশনা পেছনে ফেলে চলে গেলেন রফিকুল ইসলাম।


সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়