জীবনের গল্প, জীবন হারানোর গল্প

দেয়ালে ফুটে উঠেছে জীবনের গল্প, জীবন হারানোর গল্প।ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একটি কক্ষ। আলোর ফোকাস দেয়ালজুড়ে। সেই দেয়ালে ফুটে উঠেছে জীবনের গল্প, জীবন হারানোর গল্প। এই জীবনগুলো গত জুলাইয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শ্রমিকের। এক ফ্রেমে বাঁধা পড়েছে নিহত সব শ্রমিক। এক কিশোর শ্রমিকের হাতের লেখা কবিতার খাতা, পুড়ে যাওয়া ভবন, ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা শ্রমিকের স্যান্ডেল, তালা, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা, স্বজনদের আহাজারি—সব ছিল দেয়াল ও ডিজিটাল স্ক্রিনজুড়ে।
আজ শনিবার দৃকের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হাসেম ফুডসে শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘হাসেম ফুডসে ঝলসানো প্রাণ’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ইয়াসিন লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করত হাসেম ফুডসে। গত ৮ জুলাই কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যায় সে। মৃত্যুর পর জানা যায়, ইয়াসিন ভালো কবিতা লিখত। বড় কবি হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সেই কিশোর ইয়াসিনের কবিতা ঠাঁই পেয়েছে রাজধানীর পান্থপথের দৃক গ্যালারির এক প্রদর্শনীতে। তার কবিতা পাঠ করে শোনান প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। কবিতার শিরোনাম ‘১৬ই ডিসেম্বর’। ‘১৬ মানে একাত্তর, ১৬ মানে বিজয়, ১৬ মানে বাঙালি, আমরা মানিনি পরাজয়...’। কেবল ইয়াসিন নয়, হাসেম ফুডসে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সব শ্রমিকের নাম, ছবি, গল্প ও তাদের ব্যবহৃত কিছু জিনিস প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘আজ আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, এমন দিনে উৎসব হয়, কেক কাটা হয়। আমরা প্রতিবাদী একটি প্রতিষ্ঠান, তাই ভিন্নভাবে দিবসটি পালন করতে চেয়েছি। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে কলকারখানায় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার ও বিচারব্যবস্থার চলমান উদাসীনতাকে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাই।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো তুলেছেন দৃকের আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সুমন পাল, ইশতিয়াক করিম ও পারভেজ আহমেদ। ১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৭টি অগ্নিকাণ্ড ও শ্রমিক হতাহতের সংখ্যা প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়।

গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়। তবে পুলিশের করা মামলায় ৫১ জনের নিহত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য নাগরিক তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে দৃকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগুনে ৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর জানানো হয়।

আগুনের সময় বের হওয়ার দরজায় ছিল তালা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ন্যূনতম অপরাধবোধ নেই তাঁদের
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘হাসেম ফুডসের আগুনের ঘটনায় আমরা নাগরিক তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করি আগুন লাগার ৯ দিন পর (১৭ জুলাই)। আমরা কারখানার চারতলায় গিয়ে আগুন দেখি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা শ্রমিকের হাড়ও খুঁজে পান। অবশ্য সরকারি তদন্ত কমিটি ও কারখানার লোকজন সেই হাড় সরিয়ে ফেলে। আমরা জানতে পেরেছি, একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে সেখানে শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। শ্রমিক কম বয়সী হলে তাকে কম টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়।’

হাসেম ফুডসে আগুন নেভানোর ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার কথা নয়, সেখানে দাহ্য পদার্থ ছিল। যেখানে তালা লাগানোর কথা নয়, সেখানে তালা লাগানো ছিল। আগুন লাগলে আগুন নেভানোর যে যন্ত্র থাকে, সেটা ছিল না। এই শিক্ষাবিদ অভিযোগ করেন, বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকক হবে। সেখানে কারখানায় কেন ফায়ার অ্যালার্ম, অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। এখানে এত মানুষ মারা গেল, এতে তাদের কিছু যায়–আসে না। হাসেম ফুডসের মালিক তো বলেছিলেন, তিনি আগুন লাগাননি। তাদের মধ্যে এই বোধটুকু তৈরি হয়নি যে একটা অপরাধ করেছেন। এই ধরনের মালিক ও সরকারের যোগসাজশই হচ্ছে, মানুষকে দাসের মতো ব্যবহার করে নিজেদের মুনাফার সৌধ তৈরি করা।

অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বক্তব্য দেন
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘আমরা সেই ১৯৯০ সাল থেকে একের পর এক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। মৃত ব্যক্তিরা কেবলই সংখ্যা হিসেবে আলোচিত হয়। তাই আমরা হাসেম ফুডসের ঘটনায় নিহত প্রত্যেক ব্যক্তিকে জানার একটা চেষ্টা করেছি। যারা মারা গেছে, কেউ হয়তো কবি, কারও–বা রয়েছে ভিন্ন কোনো স্বপ্ন।’ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন শিল্পী ও সংগঠক বীথি ঘোষ ও আলোকচিত্রী সুমন পাল।