জোর করে শিশুর স্বীকারোক্তি নেওয়া হলে দুঃখজনক: হাইকোর্ট

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

বগুড়ায় ছোট ভাইকে হত্যা মামলায় ১২ বছর বয়সী বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়ে থাকলে তা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আবেদনের শুনানিতে আজ সোমবার এ মন্তব্য করেন।

বগুড়ার শিশু আদালতে চলমান ওই হত্যা মামলার যথার্থতা ও আইনি দিক পর্যালোচনায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী গত রোববার ওই আবেদন করেন, যা সোমবার শুনানির জন্য ওঠে। শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা দুঃখজনক। এমনটি ঘটে থাকলে তা দেশের জন্য দুঃখজনক। জানি না প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছে।’
রাষ্ট্রপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে বলে আদালত ২৯ জুন এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছেন।

জোর করে ১২ বছর বয়সী শিশুর স্বীকারোক্তি নেওয়া বিষয়ে ১১ জুন ‘বিয়ারিং দ্য আনবিয়ারেবল’ শিরোনামে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এটি যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী ওই আবেদনটি করেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশির উল্লাহ।
আইনজীবী শিশির মনির জানান, ওই মামলার তদন্তে অসংগতির কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামলাটি পিবিআইকে দিয়ে তদন্তের আবেদন জানালে আদালত তা মঞ্জুর করেন।

শিশু আদালতের ওই আদেশ তুলে ধরে শুনানিতে এই আইনজীবী বলেন, ‘নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা যথাযথভাবে তদন্ত না করে প্রকৃত অপরাধী বাদ দিয়ে শিশুকে নিয়ে (স্বীকারোক্তি নেওয়া ১২ বছর শিশু) মনগড়াভাবে দোষীপত্র (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে। প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। এ অবস্থায় পিবিআইকে দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা প্রয়োজন। এজাহারে খুনের শিকার আট বছর বয়সী শিশুর গলাকাটা লাশের কথা বলা আছে। সুরতহালেও গলাকাটা চিহ্নের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা দোষীপত্রে উল্লেখ করেন যে খুন হওয়া শিশুটির গলায় ধারালো কঞ্চি ঢোকানো ছিল।

এজাহার ও সুরতহাল রিপোর্টের সঙ্গে দোষীপত্রের গরমিল দেখা যায়। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে দোষীপত্র দাখিল করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পর ১২ বছর বয়সী শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশুটি আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রচণ্ড মারপিটের কথা বলে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখায়। মামলাটি সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’

শিশুটির জবানবন্দি পড়ে শুনিয়ে এরপর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিটি সংগ্রহ করেছেন আগের তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমার। সংবাদ প্রতিবেদনে এসেছে যে শিশুটির বাবা বলেছেন, পুলিশ বাসায় এসে ১২ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে গেল। থানায় গেলেও তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুমার ছেলের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দেননি। শিশুটির বাবা বলেছেন, মামলার কারণে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ছেলেটির বাবা বলেছেন, ‘প্রয়োজনে সব ছেড়ে দেব, মামলা তুলতে পারব না।’ পরে পিবিআই প্রকৃত অপরাধী হিসেবে অন্য দুজন আসামির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করেছে।

আবেদনকারীদের আইনজীবী আরও বলেন, একজন বাবা তার এক সন্তানকে (আট বছর) হারালেন, ছেলে হত্যার অভিযোগে অপর সন্তানকে (১২ বছরের শিশু) আসামি করা হলো। এমনকি মা–বাবাকে বাড়িঘরও ছাড়তে হয়েছে।
একপর্যায়ে আদালত মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান। জবাবে শিশির মনির বলেন, গত ১৫ এপ্রিল সর্বশেষ আদেশ হয় পুনঃতদন্ত বিষয়ে। এখন পুনঃতদন্ত অবস্থায়। ১২ বছর বয়সী শিশুকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি নিয়ে নেওয়া হলো, শিশু আদালতের সামনে এল কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই। উল্টো মা–বাবা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঘটনা ঘটেছে ২০১৫ সালে।

প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট ৮ বছরের শিশুর মরদেহ উদ্ধারের এক দিন পর সারিয়াকান্দি থানায় মামলা করেন তার বাবা মহিদুল। একই বছরের ২৯ নভেম্বর স্থানীয় থানা–পুলিশ তার বাড়িতে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ১২ বছর বয়সী বড় ছেলেকে নিয়ে যায় তারা। পরদিন ৩০ নভেম্বর ১২ বছর বয়সী শিশুটিকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় শিশুটি। শিশুটি জানায়, মা–বাবা ছোট ভাইকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে বলে তাকে খুন করেছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করে পরিবারের সঙ্গে থাকার অনুমতি দেন।