জোয়ার ভাটায় ডুবে থাকা জীবন

ছবি: প্রথম আলো

আম্পান ঝড়ের আঘাতে কয়রার উদ্বাস্তু একাংশ মানুষ উঠে এসেছে কাশির হাটখোলার বেড়িবাঁধে। পথের দুই পাশে লাইন দিয়ে ঝুপড়ি ঘর। আধা মাইল হাঁটলেই ডানে নিচু পথ। পথটি ভাটাতেও প্রায় ডুবে থাকা। আরও একটু এগিয়ে গেলেই ছোট এক বাড়ি।

যার উঠোন কাদায় থকথকে। বাঁশের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ড্রামের পানি তুলে গোসল করছিলেন ফাতেমা নামে এক মেয়ে। প্রতিবেশিরা জানালেন, ওর বয়স ১৭ বা ১৮ আবার ১৯ হতে পারে। সুন্দর মেয়েটি কথা বলতে পারে না তবে শুনতে পারে। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। ফাতেমা ভালো আছেন জিজ্ঞেস করতেই সে দোমড়ানো মোচড়ানো স্বরে খুব স্পষ্ট চীৎকার দিয়ে বললো ‘না’। অচেনা মানুষের কাছে প্রথম উত্তরে এত স্পষ্ট না বুঝিয়ে দিলো, তাঁর যন্ত্রণার মাত্রা। বাকশক্তিহীন ফাতেমার শব্দ ভান্ডার এক অক্ষরের। মা, হ্যা, না আর বু।  

ফাতেমার বয়স্ক বাবা জমিত সানা তখন ঘরের ভেতর চৌকিতে বসে দুই পায়ে তেল ডলছেন। একটি পাত্রে আগুন কয়লার উপর রাখা তেলটুকু রাস্তার ট্রান্সফরমারের ভেতর থেকে আনা। এই তেল কিছুক্ষণের জন্য মাংসপেশি অবশ করে রাখে, ওতে সাময়িকভাবে কষ্ট কমে। আম্পানের দিন পায়ে বড় ধরণের আঘাত পেয়েছেন। ব্যথা যেদিন বেশি হয় সেদিন কাজে যেতে পারেন না। কাজ মানে দিনমজুরের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনের মানুষ তিনি। জমিত সানার সাথে কথা বলতে বলতে দেখা গেলো, ঘরের মাটির মেঝের চারপাশে বেড়ার ভেতর দিয়ে রোদ আসছে। মেঝের সাথে টিন-পাটখড়ির বেড়ার কোথাও কোথাও এক হাত সমান হা হয়ে থাকা ব্যবধান। এই একটি ঘরেই চারজন মানুষের খাওয়া, বসা, ঘুম। চুলায় রান্না হচ্ছে দুপুরের। মোটা চালের ভাত আর নদী থেকে ধরা চিংড়ি। একবেলাই রান্না হয়। জমিত সানা জানালেন, ঝড় বৃষ্টি হলে বা পায়ের ব্যথা বাড়লে সেদিন কাজের খোঁজে যেতে পারেন না। এমনিতেও করোনার জন্য এখন তেমন কাজ নেই। নদীপাড় হয়ে আসতে হয় কয়রার দিকে। মাঝে মাঝেই উপোস করতে হয় গোটা পরিবারকে। কথা বলতে বলতে তিনি পাযের ব্যথায় ককিয়ে উঠছিলেন। পরিবারটি আম্পান ঝড়ের সময় বাঁধের উপর উঠে গিয়েছিল। পানির টান এলে আবার নিজেদের ভিটায় ফিরেছে। তবে জোয়ার-ভাটায় একদিনে দুবার করে তলিয়ে যায় তাদের ঘর। ভাটায় শুকাতে শুকাতেই আবার জোয়ার আসে।

জমিত সানার চৌকির পেছনে আড়াআড়ি করে পাতা আরেকটি চৌকি। সেখানে প্রায় অন্ধকারের মধ্যে বসে আছে আরেকজন ছোটখাটো মানুষ। ঘোমটা দেওয়া থাকায় প্রথমে ঠিক বোঝা যায়নি। মুখোমুখি হতেই একটু যেন দু পা পিছিয়ে আসতে হয়। অনাহারে অপুষ্টিতে চেহারা শীর্ণ এরমধ্যে বড় বড় দুটো চোখ আর বিশাল একটি উদর। সন্তান সম্ভবা বলে ভেবেছিলাম। এই নারীও ব্যথায় ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। অবাক করে জানালেন, উঁচু হয়ে থাকা এই পেটটির ভেতর বড় টিউমার। বছরের পর বছর ধরে তিনি এটি সয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমাঝে ব্যথা হলে মনে হয়, হাঁস মুরগি জবাই করলে নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার আগে যেমন ছটফট করে তেমন যন্ত্রণা। চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এই পরিবারটির জন্য বিলাসিতার পর্যায়ের। পারভিন নামের মেয়েটির দুই চোখই অন্ধ। আইলার সময় ঝড় থেকে বাচঁতে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তখন রাস্তায় কোনো একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে আঘাত লেগেছে। সেই থেকে আস্তে আস্তে হারিয়েছেন ডান চোখের দৃষ্টি। বাঁ চোখটি নষ্ট হয়েছে আরেক মর্মান্তিক ঘটনায়।

জমিত সানার বড় মেয়ে পারভিনের বিয়ে হয়েছিল সুন্দরবনের এক জলদস্যুর সাথে। পারভিন একদিন কাপড় কাঁচতে বসেছেন এমন সময় আরও কাপড় এনে দিলে সে বলেছিল, সাবানে কম হবে। এমন উত্তরের সাথে সাথে স্বামীর লাথি মেরেছিল পারভিনের মুখে। সে লাথি লাগলো বাঁ চোখে। এ চোখের মণির চারপাশটা সাদা হয়ে গিয়েছে ছানি পড়ার মতো। কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারলেন যে এ চোখটিও শেষ।

অন্ধ স্ত্রীকে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে গত কয়েক বছর ধরে আছেন আগের জায়গায়। এ বাড়িতে কোনো বাথরুম নেই। দুপুরে জোয়ার এলে কোমড় পানিতে যেয়ে তাদের বাথরুম করতে হয়। কোনো কোনোদিন অন্ধ পারভিন দিক বুঝতে না পেরে ভুলে আরও বেশি জোয়ার যেদিকে সেদিকে চলে যান। ভেজা কাপড়ের সেই মানুষকে চেঁচিয়ে ডাকতে হয় উল্টো স্রোত বুঝে ফিরে আসার জন্য অথবা তাঁর মা যেয়ে নিয়ে আসে। পরিবারের একমাত্র সুস্থ মানুষ ফাতেমা, পারভিনের মা। বয়স্ক মানুষটিই দেখভাল করেন অন্যদের। কাতর হয়ে বলছিলেন, কবে কোনদিন যে একটু বেখেয়ালে বড় মেয়েটি জোয়ারেই ভেসে যাবে বলতে পারি না। সে তো কিছুই দ্যাখে না। আর ছোটজন ভেসে গেলে চীৎকার করে কাউকে ডাকতেও পারবে না সাহায্যের জন্য। জোয়ারে প্রতিদিন দুইবার করে ডুবে যাওয়া এ বাড়িটি অদ্ভুত এক অনির্দিষ্ট গতিমুখের দিকে যেন যাত্রা করে আছে। বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছে চারজন মানুষ কোনোপ্রকার ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ছাড়াই। তাদের জীবনে এতটুকুও আলোর কোনো সম্ভাবনা নেই। জোয়ারে ডুবে তবুও ভাটায় জেগে উঠে কয়রা। জমিত সানার পরিবারটি অনিশ্চয়তা আর অভাবের ভেতর ডুবে আছে সবসময়ই। একজন জমিত সানা উপকূলের বহু পিতার প্রতীক। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এমন সব গল্প নিয়ে দিন কাটাচ্ছে অসংখ্য জমিত সানা পরিবার। যাদের জীবনের সাক্ষী শুধু সুন্দরবন আর নোনা পানির নদী।