জয়তু জহির রায়হান

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ (প্রথমা প্রকাশন, জানুয়ারি ২০২১) বইয়ের প্রচ্ছদ
ছবি: প্রথমা

শহীদ জহির রায়হানের (১৯৩৫-১৯৭২) সাঁইত্রিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনকে বাঙালির মহত্তম দুই ঘটনা—ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ মহিমামণ্ডিত করেছে নিঃসন্দেহে। একুশ ও একাত্তরের আভা তাঁর গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র ও সাংগঠনিক সক্রিয়তায় উপচে পড়েছে মুহুর্মুহু। তাই মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ (প্রথমা প্রকাশন, জানুয়ারি ২০২১) বইয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যবহভাবে সংকলন করা হয়েছে তাঁর ভাষা ও মুক্তিসংগ্রামের শিল্পশস্য ‘একুশের গল্প’ ও ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্প দুটি। ‘একুশের গল্প’-এর তপু যেমন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়ে বন্ধুদের কাছে ফিরে আসে জীবিতের চেয়ে বেশি জীবিত কঙ্কালরূপে, ঠিক তেমনি ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি এসে কথা বলে যেন আজও—
‘একদিন আমি আবার ফিরে যাব। আমার শহরে, আমার গ্রামে। ...যারা নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের।’

সেই মুক্তিযোদ্ধার মতো জহির রায়হানও যেন আজও গল্প শুনিয়ে চলেছেন আমাদের। তাঁর জীবনের কীর্তিমান এবং মৃত্যুর বিয়োগান্ত গল্পে ভাস্বর এই বই ‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’।

ভূমিকায় বইয়ের সম্পাদক ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালের সিঁড়িতে জহির রায়হানের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন: ‘তিনি হাত তুলে বললেন, “কেমন আছেন, কথা আছে, আসবেন।” আমি বললাম, আসব, কথা হবে। জহির ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হলো না। কথাও হলো না।

‘তারপর থেকে কত দিন ভেবেছি, একটা দায় অনুভব করেছি জহির ভাইয়ের স্মৃতিতে কিছু একটা করার। দেরিতে হলেও এই বইয়ের মাধ্যমে জহির রায়হানকে স্মরণ করতে চেয়েছি, যিনি তাঁর জীবন ও সৃষ্টিতে বাংলার সংগ্রামী ঐতিহ্যকে স্মরণীয় করে রেখেছেন।’

তবে নিছক স্মারকগ্রন্থ নয় এ বই; একই সঙ্গে তা জহির রায়হানের সৃষ্টকর্মের মূল্যায়ন এবং তাঁর হত্যারহস্যের উন্মোচন করেছে।

কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা স্কেচ দর্শন ও ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত জহির রায়হানের প্রথম কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ পাঠ শেষেই পাঠক প্রবেশ করবেন ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়ে। জুলফিকার আলি মাণিকের ‘জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ’, অনল রায়হানের ‘পিতার অস্থির সন্ধানে’-এর মতো সুদীর্ঘ অনুসন্ধানী রচনার পাশাপাশি শামসুর রাহমান ও শাহরিয়ার কবিরের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হানের ‘রহস্যজনক অন্তর্ধান’ প্রকৃতপক্ষে একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের সন্ধানে স্বাধীন স্বদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে গিয়ে অবাঙালি ঘাতকগোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। একাত্তর-উত্তর সময়েও পাকিস্তানি হানাদারদের দোসরকবলিত যে মিরপুরকে জুলফিকার আলি মাণিক যথার্থই বলেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন’।

আর পিতার অস্থির সন্ধানে বধ্যভূমিতে ঘুরে বেড়ানো পুত্র অনল রায়হানের অনুভব যেন লাখো শহীদের রক্তস্নাত বাংলার পরানের গহিন ভেতরের কথা: ‘একসময় মনে হতো পিতা এসে দাঁড়াবেন, আমার মাথায় হাত রাখবেন। আমি মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া একটি মাথার খুলির ওপর হাত রেখে চিহ্নিত করতে চাইলাম পিতাকে। হয়তো একই করোটিতে হাত রাখবে আরও কয়েক শ জন, কয়েক সহস্রজন। বলবে, এ আমার পিতা। এই তো আমার ভাই, এই তো আমার বোন...’

‘স্মরণ’ অংশে সংকলিত হয়েছে প্রায় ৫০ বছর আগে জহির রায়হানের পুত্রদের প্রতি লেখা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পত্রপ্রবন্ধ ‘অপু-তপুকে’। প্রিয় জহিরের স্মৃতিচারণা করে পিতৃহারা সন্তানদের তিনি বলেন সেই জরুরি কথা: ‘তোমরা বড় হয়ে নিশ্চয়ই জহিরের খোঁজ করবে। আর জহিরের খোঁজ নিতে গিয়ে শহীদুল্লারও খোঁজ করতে হবে। তাদের দেহের নয়, তাদের মনের খোঁজ তোমাদের খুঁজে পেতে হবে কোথায় কোথায় তারা তাদের মন দিয়ে গেছে। আমি চাই বড় হয়ে তোমরাও সেই সেই জায়গায়তেই মন দাও।’

জহির রায়হান

জহির রায়হানের সমসাময়িক কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন জহিরের সাহিত্যজীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ‘জহিরকে যখন জানতাম’ লেখায়। তরুণ জহিরের উপন্যাস-ভাবনার নতুনতা রাবেয়া শনাক্ত করেন জহিরের বয়ানেই: ‘বলত, “কথাসাহিত্যের ধরাবাঁধা ধ্যানধারণা, আঙ্গিক ভাঙতে শুরু করেছে বিভূতিভূষণের “পথের পাঁচালী” থেকে। এ আরও ভাঙবে। ভাঙাচোরা থেকে দিনে দিনে তৈরি হবে নতুন ছক, নতুন ধারণা, নতুন ছবি।’

‘জহির ফিরে এল না’ শিরোনামে সুচন্দার লেখায় দাম্পত্যজীবনের মধুর-বিধুর স্মৃতিচারণার পাশাপাশি ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটও বর্ণনা করেছেন:
‘একটি ছবির কাজে জহির একবার আমাকে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। কাজের ফাঁকে আমরা একটা ছবি দেখতে গেলাম। আগের শো তখনো শেষ হয়নি। হলের সামনে একটি রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জহির কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। মৃদুকণ্ঠে বলল, “আমি এমন একটা ছবি বানাতে চাই, যেখানে দেশের কথা থাকবে; থাকবে ভাষা দিবসের কথা। ছবিটা দেখে মানুষ উপলব্ধি করবে, আমাদের স্বাধিকার দরকার। কিন্তু আমি সেটা বলতে চাই একটা সুন্দর গল্পের মধ্য দিয়ে।”’

মতিউর রহমানের ‘জীবনের একটু আগুন চাই’ লেখায় আঁকা হয়েছে নিরন্তর মুক্তিসংগ্রামী জহির রায়হানের প্রতিকৃতি: ‘জহির রায়হান শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; জীবনের অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন “আর কত দিন”-এ। আর তাঁর গভীর প্রশ্ন ছিল, সারা বিশ্বে আর কত দিন নির্যাতন, হত্যা আর ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া চলবে? আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ আর চিন্তার গভীর প্রতিফলন ছিল এতে।’

‘চিঠি ও আলাপন’ পর্বে সুমিতা দেবীকে লেখা জহির রায়হানের সুদীর্ঘ চিঠি জহির রায়হানের ভিন্নতর রচনা নিদর্শন। জহিরের নিজেরই ভাষায় ‘এটা কোনো প্রেমপত্র নয়। উপদেশলিপি নয়। হতাশার আগুনে দগ্ধ একটি মানুষের করুণ আকুতিও নয়। এটা হলো দীর্ঘ এক বছর ধরে ঘটে যাওয়া একটি অসাধারণ বিয়োগান্ত নাটকের সাধারণ যবনিকা পতন।’

চলচ্চিত্র সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খানের সঙ্গে ‘জীবন থেকে নেয়া’-র নির্মাণ প্রসঙ্গে ১৯৭০ সালে প্রদত্ত এক হ্রস্ব কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের সংযোজনও ঘটেছে বইটিতে। ‘যদি পত্রিকার পৃষ্ঠায় গণ-আন্দোলনের খবর লেখা যেতে পারে, ছবি ছাপা হতে পারে, তবে সে আন্দোলনকে বিষয়বস্তু করে চলচ্চিত্র তৈরি করা যাবে না কেন?’—সাংস্কৃতিক সংগ্রামী জহির রায়হানের এমন শাণিত ভাবনায় সমুজ্জ্বল এ সাক্ষাৎকার। জহির রায়হানের রচনা-নিদর্শন হিসেবে তাঁর গল্পের পাশাপাশি ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধটির অন্তর্ভুক্তিও তাই গুরুত্ববহ।

পরিশিষ্টাংশে সংযোজিত জহির-সহোদর জাকারিয়া হাবিব, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এবং চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের স্মৃতিলেখার অক্ষর-রেখায় ফুটে ওঠে নানামাত্রিক জহির রায়হানের অনুপম ছবি।

চলচ্চিত্র পুরস্কার হাতে জহির রায়হান
ছবি: সংগৃহীত

‘মুহূর্ত নায়ক’ নামের লেখায় কাইয়ুম চৌধুরীর ফিরে দেখা:
‘লিখছেন আর কাটছেন। একদিন আমার হাতে তুলে দিলেন। মতামতের জন্য। উপন্যাসের নাম “ধলপহর”। আবহমান বাংলা, তার নদী ও মানুষের কাহিনি। উপন্যাসের বিরাট পটভূমির মতো। বহু পরিবর্তন ও পরিমার্জনার ফসল “ধলপহর”, “হাজার বছর ধরে” নাম নিয়ে অনেক দিন বাদে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় এবং এ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্মান অর্জনে সক্ষম হয়।’

‘আমার বন্ধু জহির’ লেখায় ফজল শাহাবুদ্দীনের স্মৃতিস্নিগ্ধ বিবরণে আছে মুক্তিযুদ্ধের সোচ্চারকণ্ঠ জহির রায়হানের পরিচয়: ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জহির কথা বলছেন। বাংলাদেশের মানুষের কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতেই হবে, বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জ্বলন্ত সূর্যের নিচে নিয়ে যেতেই হবে।’

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ বইয়ে এসব লেখা আছে; আরও আছে জহির-জীবনের অসাধারণ কিছু আলোকচিত্র। চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট থেকে তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি তো বটেই, আছে একুশের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভকে সাক্ষী রেখে তোলা জহির রায়হানসহ লড়াকু ভাষাসংগ্রামীদের ছবি কিংবা একাত্তরের কলকাতায় প্রতিবাদ সমাবেশের সম্মুখসারিতে বসা যোদ্ধা জহিরের ছবি।
বেঁচে থাকলে জহির রায়হান ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন করতেন আজ। তবে জহিরবিহীন বাংলাদেশে আমরা তো মৃত্যুকূপ থেকে জহির রায়হানের মতো লাখো শহীদকে নিরন্তর বেঁচে উঠতে দেখছি তাঁরই লেখা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তির মতোই:

‘মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে!’

মৃত্যুর বাস্তবে জীবনের জয়গান মানেই জহির রায়হান। জয়তু জহির রায়হান।