জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ

চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত জয়িতারা
চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত জয়িতারা

গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে চট্টগ্রাম বিভাগের জয়িতাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই ক্রোড়পত্রে জয়িতাদের সাফল্যগাথা  প্রকাশিত হলো।
একজন সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল আর চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে—১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগভিত্তিক জয়িতা বাছাইয়ের কাজটি পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ক্যাটাগরিভিত্তিক মনোনীত এক হাজার ২২৯ জন জয়িতার মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে ৪৪১ জন, জেলা পর্যায়ে ৫৬ জন ও বিভাগীয় পর্যায়ে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মনে করে, জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। আর তা হলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।

সংশোধনী: গত ১৭ মার্চ প্রকাশিত খুলনা বিভাগের জয়িতা ক্রোড়পত্রের এই অংশে ১১ তম লাইনে ভুলবশত ছাপা হয়েছে ‘রাজশাহী’, সেখানে পড়তে হবে ‘খুলনা’। দুঃখিত।

পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ

বিবি ফাতেমা
বিবি ফাতেমা

‘অনিশ্চিত জীবনকে অনেকখানি পেছনে ফেলেছি। নিজের অধ্যবসায় ও মায়ের একান্ত প্রচেষ্টায় এতটুকু এসেছি। এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। সমাজে নিজের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চাই।’ কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে  স্বীকৃতি পাওয়া বিবি ফাতেমা। জীবনের  দুর্বিষহ পথ অতিক্রম করে তাঁকে এখানে আসতে হয়েছে। মায়ের গর্ভে থাকার সময়েই বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর স্বামীর বাড়িতে মায়ের ঠাঁই হয়নি। সৎনানি ও মামাদের জন্য নানাবাড়িতেও জায়গা হয়নি তাঁদের। ফাতেমার বয়স মাত্র তিন মাস। বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই পৃথিবীতে বড়। মা শুরু করেন গৃহকর্মীর কাজ। শুরু হয় মা-মেয়ের সমাজে টিকে থাকার যুদ্ধ। শৈশবে ফাতেমাও মায়ের সঙ্গে গৃহকর্মীর কাজ করেন। পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে যান ফাতেমা। মায়ের স্বপ্ন যে করেই হোক মেয়েকে শিক্ষিত হতে হবে।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ফাতেমা শুরু করেন টিউশনি। এভাবে পড়েও ভালো করেন এসএসসি পরীক্ষায়। তিনি আরও  আত্মবিশ্বাসী হন। সবাই চাইতেন পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরি করুক। বিয়ে হোক ফাতেমার। কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মা-মেয়ে। ২০০৬ সালে ফেনী সাউথ ইস্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি একটি চাকরির পরীক্ষা দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করে। নিজের মধ্যে  এখানে পড়ার ভীষণ ইচ্ছে তৈরি হয়। সবাইকে বিস্মিত করে পরের বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে দেখা দেয়।

তিনি  ফেনী সদরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। চাকরির সঙ্গে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যান। ফাতেমা  ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেন। ফাতেমা বর্তমানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। জীবনের চড়াই-উতরাই পার হওয়া আত্মবিশ্বাসী ফাতেমার পরবর্তী লক্ষ্য, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়া। ফাতেমা বলেন, ‘আজ পর্যন্ত নিজের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। এসবের পরও নিজের অতীত এখন আর আমার কাছে গ্লানির নয়, গর্বের।’

দিন কাটে স্বপ্নের মতো

পূর্ণশোভা চাকমা
পূর্ণশোভা চাকমা

‘জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আসবে। তাই বলে থেমে থেকো না। ভেঙে পোড়ো না। সুদিন আসবেই। এই আমাকে দেখো, কোথা থেকে কোথায় এসেছি। তোমরাও পারবে।’ জোরালো কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন রাঙামাটির পূর্ণশোভা চাকমা। তিনি নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা বিভাগে জয়িতা হয়েছেন। এ পর্যন্ত আসতে জীবনের সঙ্গে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
১৯৮৭ সালের ২০ এপ্রিল। পূর্ণশোভার মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে দিনটি। দীঘিনালায় শান্তিবাহিনীর হাতে খুন হলেন স্বামী বিজয়শীল চাকমা। মুহূর্তেই তছনছ হয়ে গেল সাজানো সংসার। দুই সন্তান নিয়ে অথই সাগরে পড়লেন। লেখাপড়াও মাত্র অষ্টম শ্রেণী। তবে সাহস হারাননি। দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু করলেন বাঁচার লড়াই। ছোট একটি চাকরিও পেলেন। কিন্তু কপালে সবার নাকি সুখ সয় না। সইল না পূর্ণশোভারও। চাকরির এক বছরের মাথায় ঘটল আরেক অঘটন। লংগদুতে শুরু হলো পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। ভয়াবহ দাঙ্গার হাত থেকে সন্তানদের বাঁচাতে চান। তাই রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে হারিয়ে ফেললেন দুই ছেলে জাগরণ চাকমা (৮) ও পল্লব চাকমাকে (৫)। নিজেও আহত হলেন। অচেতন পূর্ণশোভাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর এক বাঙালি বান্ধবী। সেখানে দেখা পান ছেলে পল্লব চাকমার। কিন্তু আরেক বুকের ধন জাগরণ কোথায়? জাগরণ আর কখনো মায়ের কোলে ফিরে আসেনি। স্বামী-সন্তান হারিয়ে পূর্ণশোভা দিশেহার হয়ে পড়েন। তৎকালীন সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড কমান্ডার তাঁকে সহযোগিতা করেন।

আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ পেল। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর পাস করে। এদিকে আসে আরও একটি সুখবর। অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি পায় সন্তান। দুই বছর পর ছেলেকে বড় ঘরে বিয়ে দেয়। এখন তাঁর দিনগুলো কেটে যায় স্বপ্নের মতো। নিজের পরিবারের পাশাপাশি নারীদের স্বাবলম্বী করতে চান। এর জন্য  ১৯৯৪ সালে গঠন করেন জাগরণী মহিলা সমিতি। শুরু থেকেই এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক তিনি। বর্তমানে সমিতির সদস্য ৬২ জন। কোমরতাঁত, হাঁস-মুরগি পালনসহ নানা বিষয়ে  তিনি প্রশিক্ষণ  দেন। দৃঢ়বিশ্বাস, উদ্যম আর সৎসাহস থাকলে তাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। পূর্ণশোভা প্রমাণ করেছেন, যেকোনো জায়গা থেকে জীবন শুরু করা যায়।

ছিল মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি

রহিমা বেগম
রহিমা বেগম

১৩ বছর বয়সেই বিয়ে হয় রহিমা বেগমের। স্বামী সরকারি চাকুরে। সুখেই ছিলেন। ১২ বছরের সংসারে পাঁচ সন্তান। হঠাৎ একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ১৯৮৭ সাল। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান স্বামী। সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স তিন মাস, বড়টির নয় বছর। সন্তানের মুখের দিকে তাকালে বুকটা তাঁর হাহাকার করে ওঠে। এতগুলো সন্তান নিয়ে কীভাবে চলবেন।  অনিশ্চয়তার মধ্যে পথ খুঁজতে থাকেন। নিভে যেতে থাকে আশা-ভরসার সব বাতি। কোনো উপায় না দেখে সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। সম্বল স্বামীর সামান্য কিছু পেনশনের টাকা।
এই টাকায় সংসারই চলে না, কীভাবে সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন? দৃঢ় মনোবল ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে  জীবনের সঙ্গী করলেন। তিনি বাড়ির নারকেল, সুপারি, অন্য ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি বিক্রি করে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতে থাকেন। অনেক সময় তাদের খাবার দিতে পারতেন না। পোশাক দিতে পারতেন না। খেয়ে না-খেয়ে কোনো রকম দিন যাপন করেছেন। এর পরও রহিমা বেগমের প্রত্যেক সন্তান সাফল্য অর্জন করেছেন। বড় সন্তান এমএসএস ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। দ্বিতীয় সন্তান বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তৃতীয় সন্তান স্নাতকোত্তর  অর্জন করে চাকরি করছেন। চতুর্থ সন্তান দর্শনশাস্ত্রে এমএ পড়ছেন। পঞ্চম সন্তান বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন।

প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মানসিক শক্তির বলে এই সাহসী নারী জয়ী হয়েছেন। অনেক প্রতিবন্ধকতা, চড়াই-উতরাই  পেরিয়ে তিনি একজন সফল গর্বিত জননী। তিনি জননী ক্যাটাগরির শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন।

চাই মনের জোর

রোজি আক্তার
রোজি আক্তার

ছয় বছর বয়সে পোলিওতে এক পায়ের জোর হারান রোজী আক্তার। দশম শ্রেণীতে ওঠার পর বন্ধ হয় লেখাপড়া। ১৫ বছর বয়সে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। স্বামীর  সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এত কিছুর পরও দমে যাননি। একটি সেলাই মেশিন ঘুরিয়ে দিয়েছে জীবনের মোড়। জয় করেছেন প্রতিবন্ধিতা। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অন্যদেরও পথ দেখাচ্ছেন। ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান’ রাখায় পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের জয়িতা খেতাব। রোজী  বলেন, ‘১৯৯৩ সালে আমার বিয়ে হয়। স্বামীর তেমন কিছু ছিল না। তার ওপর আমি প্রতিবন্ধী। কিন্তু  কখনো মনোবল হারাইনি।
স্বামীকে সাহায্য করার পথ খুঁজতে থাকি। শেষে হাতে নিলাম সেলাই মেশিন। ১৯৯৫ সালে মৈত্রী টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিলাম। প্রশিক্ষণ শেষে ঘরে বসে নিজে টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করেছি। ১৯৯৬ সালে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প থেকে আরও ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিই। এরপর আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। আমার মা দেড় হাজার টাকায় কিস্তিতে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। এভাবে আমার জীবন বদলে যেতে শুরু করে।’ সাহস, আত্মবিশ্বাস, সাফল্য—এই তিনটি রোজীর জীবনের অনুষঙ্গ। শত বাধা পেরিয়ে হাতের মুঠোয় এনেছেন সাফল্য। রোজী এখন স্বাবলম্বী। এ ছাড়া কাজ করছেন সমাজের প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে।
২০০১ সালে গঠন করেন পানছড়ি উপজেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংঘ। শুরু থেকে এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তিনি। সংগঠনের মাধ্যমে ৭৭৫ জন প্রতিবন্ধী নানাভাবে সমাজ উন্নয়নে কাজ করছেন। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিবন্ধী নারীদের বিনা মূল্যের সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রায় ৩০০ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। রোজী এখন জনপ্রতিনিধিও। ২০১১ সালের জুনে পানছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেলাই মেশিন প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। এখন  যৌতুকবিহীন বিয়ে, বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিং রোধ ও নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, একজন শিক্ষিত মা শুধু সন্তানকে সুশিক্ষিতই করেন না, সমাজ বদলেও বিরাট ভূমিকা রাখেন। শেষে রোজী বলেন, ‘মনের জোর থাকলে সব বাধা ডিঙানো সম্ভব।’

দুঃখ এখন অতীত

ছেনোয়ারা বেগম
ছেনোয়ারা বেগম

বছর পঞ্চাশের ছেনোয়ারা বেগম। ছোটখাটো গড়ন। বোরকায় ঢাকা আপাদমস্তক। চেহারায় বয়সের রেখা। সাদামাটা চালচলন। কথা বলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। মুঠোফোন নম্বর চাইতেই বললেন, ‘অবাপ, আঁই তো নম্বর টিপিত ন জানি। তুঁই লেহি দ।’ অক্ষরজ্ঞান বলতে নিজের নামটাই লিখতে পারেন। তবে হিসাবে পাকা। এক পয়সাও এদিক-ওদিক হওয়ার সুযোগ নেই। এই ছেনোয়ারা চট্টগ্রাম বিভাগে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী।
৩০ বছর আগের ঘটনা। ছেনোয়ারার বয়স তখন ২০। বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামী ছেড়ে যান। তখন তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এরই মধ্যে তিনি কন্যা সন্তানের জননী হলেন।  ছেনোয়ারার হাত শূন্য। বাপের বাড়িতে কোনো রকমে আশ্রয়। সারা দিন মানুষের খেত-খামারে কাজ করেন। কোনো রকমে দিন চলে মা-মেয়ের। এভাবে চললে মেয়েকে মানুষ করবেন কীভাবে? সেই চিন্তায় ভেঙে পড়েন ছেনোয়ারা। শেষে উপায় বের করলেন—এক মণ ধান দিয়ে ব্যবসা শুরু। প্রথমবার লোকসান হলো।
তবে আশা হারাননি। আবার ধান কিনে চাল করলেন। এবার শুধরালেন আগের বারের ভুল। কিছুটা লাভ হলো। এভাবে শুরু। লাভ বাড়ার সঙ্গে বাড়ল ছেনোয়ারার ব্যবসাও। এক মণ হলো এক শ মণ। প্রথমে নিজে মাথায় করে বাজারে চাল নিয়ে বিক্রি করতেন। এরপর ভ্যান। সর্বশেষ মিনি ট্রাক। ব্যবসার পরিধি এখনো বাড়ছে। মালিক হয়েছেন পাঁচ একর জমির। অন্যদের জমি বর্গা নিয়েও চাষাবাদ করছেন। পালন করেন গাভি ও হাঁস-মুরগি। এখন নিজের পাশাপাশি অন্য মেয়েদেরও উদ্বুদ্ধ করছেন ব্যবসায়। এদিকে নিজে লেখাপড়া না জানার দুঃখ ঘুচিয়েছেন একমাত্র মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে দিয়ে। মেয়েকে স্নাতক পর্যন্ত পড়িয়েছেন।

শুধু তা-ই নয়, ছেনোয়ারার মেয়ে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মেয়ে-নাতির ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এরাই আমার সব।’ দুঃখভরা জীবন এখন ছেনোয়ারার কাছে অতীত। সামনের দিনগুলোতে স্বপ্ন দেখছেন আরও এগিয়ে যাওয়ার।

যাঁরা জয়িতা হলেন

রহিমা বেগম            : ক্যাটাগরি: সফল জননী যে নারী, গ্রাম: পাথৈর, উপজেলা: শাহরাস্তি, জেলা: চাঁদপুর, চট্টগ্রাম

পূর্ণশোভা চাকমা     : ক্যাটাগরি: নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে যে নারী ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, গ্রাম: সংঘারাম বিহার এলাকা, উপজেলা/জেলা: রাঙ্গামাটি

ছেনোয়ারা বেগম     : ক্যাটাগরি: অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, গ্রাম: খুরুশিয়া, উপজেলা: রাঙ্গুনিয়া, জেলা: চট্টগ্রাম

রোজী আক্তার        : ক্যাটাগরি: সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী, গ্রাম: পানছড়ি সদর, উপজেলা: পানছড়ি, জেলা: খাগড়াছড়ি

বিবি ফাতেমা          :  ক্যাটাগরি: শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী, গ্রাম: ফাজিলপুর, উপজেলা/জেলা: ফেনী, চট্টগ্রাম

জয়িতা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি আগামীকাল ২৫ মার্চ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হবে

তত্ত্বাবধানে: মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

আয়োজনে: মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর

বাস্তবায়নে: বিভাগীয় প্রশাসন, চট্টগ্রাম

প্রচার সহযোগিতায়: প্রথম আলো -চ্যানেল আই