জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে ঢাকা বিভাগের জয়িতাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই ক্রোড়পত্রে জয়িতাদের সাফল্যগাথা প্রকাশিত হলো

ঢাকা অঞ্চলের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত জয়িতারা
ঢাকা অঞ্চলের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত জয়িতারা

একজন সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতা জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে—১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগভিত্তিক জয়িতা বাছাইয়ের কাজটি পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিভাগে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ক্যাটাগরিভিত্তিক মনোনীত দুই হাজার ছয়জন জয়িতার মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে ৫৪২ জন, জেলা পর্যায়ে ৮৫ জন ও বিভাগীয় পর্যায়ে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মনে করে, জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। আর তাহলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।

সাধারণ মেয়ের গল্প

সেলিনা আক্তার শিল্পী
সেলিনা আক্তার শিল্পী

‘পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু, নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প—যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়।’
সেলিনা আক্তার শিল্পী যেন রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার সাধারণ মেয়ে। অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। দূর থেকে একাকী সংগ্রাম করেছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। সমাজের মূলধারায় ফিরে আসার যুদ্ধে হয়েছেন জয়ী। জীবনের চরম মূল্য দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাঁকে। সেলিনা আক্তারের জীবনের শুরুটা অত্যন্ত নির্মম।
অভাবের মধ্য দিয়ে জীবন চলছে। তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়া হয় না। এভাবেই কৈশোর পার করে পা রাখলেন যৌবনে। এলাকার কিছু খারাপ মানুষ তাঁকে উত্ত্যক্ত করত। এদেরই একজনের কাছে জীবনের চরম মূল্য দিতে হলো। সব চেষ্টা করেও কোনোভাবেই সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারলেন না। ২১ বছরের সেলিনা হলেন অন্তঃসত্ত্বা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল ঘটনা। কেউ তাঁর পাশে নেই। কয়েক শ কোটি মানুষের বিশাল পৃথিবীতে সেলিনা কেবল একা। সহানুভূতির পরিবর্তে সবাই তাঁকে ধিক্কার জানাচ্ছে। অপরাধী পুরুষ রয়ে গেল ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেলিনাকেই দেওয়া হলো সব অপবাদ।
এ যেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই মালতি। ‘এমন অনেক মালতি আছে বাংলাদেশে, তারা সবাই সামান্য মেয়ে। তারা ফরাসি-জার্মান জানে না, কাঁদতে জানে।’ অন্যায় না করেও সব অপবাদ দেওয়া হয় তাঁকে। ক্ষেভে-দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে একাকার হন সেলিনা। তার পরও ভেঙে পড়েননি। এরই মধ্যে এক কন্যাসন্তানের জননী হন। সন্তান জন্মের পর এলাকার মানুষ তাঁকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে।
এদিকে স্ত্রীর মর্যাদার জন্য সন্তানের বাবার সঙ্গে রাত-দিন চেষ্টা চালাচ্ছেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর একপর্যায়ে তিনি স্ত্রীর মর্যাদা পান। সেলিনা মুছে ফেলেন যত গ্লানি। শুরু করেন জীবনের নতুন এক অধ্যায়। সেলিনা এখন স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তিনি সুখে-দুঃখে গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ান। গ্রামের মানুষও তাঁকে সম্মান করে, ভালোবাসে। তিনি নিজের ও মানুষের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন। এই ভাবনা থেকেই ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনে সদস্য নির্বাচিত হন। সেলিনার এই বিজয় নজরুলের ‘নারী’ কবিতার দুটো পঙিক্ত আমাদের মনে করিয়ে দেয়—‘সেদিন সুদূর নয়—যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’

পথ হারাননি দিলরুবা

শাহনওয়াজ দিলরুবা খান
শাহনওয়াজ দিলরুবা খান

‘নারীকে শিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, তাহাদের নিজেদের অন্নসংস্থান নিজেরা করুক।’ বেগম রোকেয়ার এ বাণী বুকে ধারণ করে এগিয়েছেন শাহনওয়াজ দিলরুবা খান নামের এক শংসপ্তক নারী।
শিক্ষার প্রতি অদম্য স্পৃহা, দৃঢ় মনোবল তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। জীবনের পদে পদে চরম বাধা এসেছে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই পথ হারাননি দিলরুবা। বাধার প্রাচীর পেরিয়ে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। দরিদ্র বাবার পক্ষে আট ভাইবোনের সংসার চালানো সম্ভব ছিল না। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন দিলরুবা। এসএসসি পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফল করলেন।
কিন্তু দরিদ্র বাবার পক্ষে আর পড়ানো সম্ভব হলো না। বিয়ে দেওয়া হলো ইচ্ছার বিরুদ্ধে। একটু পড়ার সুযোগের জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু কেউ বুঝতে চায়নি তাঁর চোখের জলের ভাষা। অবশেষে নিজের খরচে কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনার জন্য স্বামীর বাড়ির লোকজনের সহযোগিতা
পাননি। বিভিন্ন কারণে শ্বশুরবাড়ির প্রতি নাখোশ ছিলেন স্বামী। অবশেষে দিলরুবা তাঁর বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার শর্তে পড়ার সুযোগ পান। শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। দিন কাটে সংসারের কাজে। কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা ও টিউশনি করে। ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে রাতের বেলা পড়া চালিয়ে যান দিলরুবা। একসময় তিনি সন্তানের মা হন। সংসার, সন্তান ও চাকরি—সব একই সঙ্গে করতে
হয়। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসএস ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। তিনি বাল্যবিবাহ রোধ, নারী শিক্ষার উন্নয়ন, নারী নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধ, মাদক প্রতিরোধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন। প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন ও আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করেন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীদের জন্য গড়ে তোলেন ‘গাজীপুর বিজনেস ফোরাম ফর ট্রেইনড পুওর উইমেন এন্টারপ্রেনারস’। তাঁর একক প্রচেষ্টায় একজন দাতা ব্যক্তির এক কোটি ৫০ লাখ টাকা অনুদানে গাজীপুর সদর উপজেলায় শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়ার উপযোগী ভবন নির্মিত হচ্ছে। তিনি সারা জীবন মানুষের জন্য কাজ করতে চান।

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখান

সুফিয়া বেগম রোজী
সুফিয়া বেগম রোজী

উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় সুফিয়া বেগম রোজীর বিয়ে হয়। বিয়ের পর এইচএসসি পরীক্ষা দেন, কিন্তু ফল ভালো হয়নি। সংসারে অভাব-অনটন, তাই আর পড়া হয়নি। তিনি ব্র্যাকের একটি স্কুলে ১৯ বছর চাকরি করেন। পরবর্তী সময়ে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে মাছের চাষ, কৃষিকাজ, ব্লক, বাটিক, নকশিকাঁথা, দরজিবিজ্ঞান প্রভৃতির প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের পর তিনি যুব উন্নয়নকেন্দ্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে থাকেন।
একপর্যায়ে নিজস্ব উদ্যোগে গ্রামের নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেন। পরবর্তী সময়ে ‘অবলা মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। গ্রামের দরিদ্র নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখান। তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার নারীকে সেলাই, এমব্রয়ডারি, ব্লক, বাটিক, কারচুপি, নকশিকাঁথা, ক্রিস্টালসহ বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা এসব কাজ করে অর্থ আয় করছেন এবং তাঁদের সংসার চালাচ্ছেন।
সুফিয়া বেগম তিন সন্তানের জননী। তিনি সমিতির মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। এ ছাড়া যৌতুক প্রথা ও বাল্যবিবাহ নির্মূলে ভূমিকা রাখছেন। সুফিয়া বেগম সমাজের অসহায় ও দুস্থ নারীদের ঐক্যবদ্ধ করে তাঁদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন। তিনি সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মহিলা অধিদপ্তর সুফিয়া বেগমকে সমাজ উন্নয়ন ক্যাটাগরিতে জয়িতা নির্বাচিত করেছে।

স্বপ্নভঙ্গ ও স্বপ্নপূরণের গল্প

বেগম সুরাইয়া ফারুকী
বেগম সুরাইয়া ফারুকী

জীবনের আনন্দ-বেদনা বুঝে ওঠার আগেই সুরাইয়া বেগম মাকে হারান। তাঁরা দুই বোন। একজনের বয়স চার, অন্যজনের দুই বছর। মা-হারা দুই বোনের আশ্রয় হয়েছে নানিবাড়িতে। নানিবাড়িতে আশ্রয়কেই তিনি সৌভাগ্য মনে করেন। সুরাইয়া বেগমের বাবা ছিলেন শিক্ষিত, সজ্জন, সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব। বাবা ও দাদির তত্ত্বাবধানে শেষ করেন প্রাথমিক শিক্ষা। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় সুরাইয়ার বিয়ে হয়। কিশোরী সুরাইয়ার বিবাহিত জীবন শুরু হলেও লেখাপড়া বন্ধ করেননি। এরই মধ্যে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পড়ালেখায় কিছুটা অনিয়মিত হন। ১৯৫৭ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। স্বপ্ন ছিল অনেক পড়াশোনা করবেন। কিন্তু একে একে তিনি হন নয় সন্তানের জননী। স্বামী ছিলেন জেদি প্রকৃতির।
সরকারি-বেসরকারি কোনো চাকরিতে বেশি দিন স্থির থাকতে পারতেন না। ধীরে ধীরে সংসারে অসচ্ছলতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। অভাবের কারণে একসময় শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসতে হয়। নিজের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বুকে চাপা দিয়েছেন। সন্তানদের মধ্যেই তাঁর স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনা দেখেছেন। নয় সন্তানের লেখাপড়া, বই-পুস্তক, কাগজ-কলম জোগাড়, পোশাক, স্কুলের বেতন, স্কুলে যাতায়াতের সমস্ত বিষয় তাঁর তদারকিতেই সম্পন্ন হতে থাকে।
অর্থের অভাবে স্কুলপর্যায় পর্যন্ত নিজেই সন্তানদের পড়া দেখিয়ে দিতেন। সন্তানদের পরিমিত স্নেহ ও শাসনের মধ্যে রেখেছেন। তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন প্রতিকূলতা জয় করার শক্তি। স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন নিজেকে বড় মানুষ হিসেবে তুলে ধরার। মায়ের অনুপ্রেরণা সঙ্গী করে সন্তানেরাও এগিয়ে গেছেন উচ্চশিক্ষার পথে। দুই মেয়ে ও সাত ছেলের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পর দুরারোগ্য ব্যধিতে এক সন্তানের মৃত্যু হয়। বাকি আট সন্তানই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। এক ছেলে যুক্তরাজ্য থেকে বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেছেন।
সন্তানদের মধ্যে তিনজন বিসিএস পাস করেছেন। তাঁদের একজন বর্তমানে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অপর দুজনের একজন অতিরিক্ত কর কমিশনার, অন্যজন অধ্যাপক হয়ে পিএইচডি গবেষণায় রত। অন্য সন্তানেরাও সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। স্বামী, সন্তান, সংসারের প্রয়োজনে নিজের স্বপ্নসাধ বিসর্জন দিয়েছেন। সন্তানদের মধ্যে স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটাতে পারার বিরল কৃতিত্বে বেগম সুরাইয়া ফারুকী আজ সফল জননী।

অসীম সাহসী এক নারী

রাবেয়া খাতুন
রাবেয়া খাতুন

তখন মাত্র ৪০ দিনের মা-হারা শিশু। দুঃখ-কষ্ট সঙ্গে নিয়েই পৃৃথিবীতে এসেছেন। জীবনের শুরুতে তাঁর ঝরে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু না, এই নারী অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করেছেন। দৃঢ় মনোবল আর অসীম সাহস নিয়ে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে চলা এই নারীর নাম রাবেয়া খাতুন।
বাবা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। মামার বাড়িতে বড় হন রাবেয়া। মামির নির্মম আচরণে পড়ালেখার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তাঁর। প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট নিয়ে পার করেন শৈশব-কৈশোর। তারপর ভালোবেসে বিয়ে করেন দরিদ্র আবুল হাসেমকে। উভয় পক্ষের অভিভাবকেরা এ বিয়ে মেনে নেননি। ভয়ানক মানসিক নির্যাতন। অন্ন-বস্ত্রসহ টিকে থাকর সংগ্রাম। সবকিছু মিলিয়ে বিপর্যস্ত রাবেয়ার জীবন। তাঁর জীবনে কোনো সুখের স্মৃতি নেই। জন্ম থেকেই মানুষের নির্মমতা বারবার রাবেয়াকে যন্ত্রণা দিয়েছে।
এবার রাবেয়া উঠে দাঁড়াতে চান। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে উদ্যোগ নেন ক্ষুদ্র ব্যবসার। অনেক কষ্ট করে ১০টি মুরগি সংগ্রহ করেন। এখান থেকে তিনি ১০০টি ডিম পান। কাপড়ের সাহায্যে বাচ্চা ফোটানোর নিজস্ব পদ্ধতি তিনি বের করেন। ৯০টি ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। বাচ্চাগুলো নিয়ে একটি মুরগির ফার্ম করেন। এরপর তিনি হ্যাচারির ওপর প্রশিক্ষণ নেন। বর্তমানে তাঁর ফার্মে প্রতি মাসে ৬০০ থেকে ৭০০ বাচ্চা ফোটাতে সক্ষম। রাবেয়া এখন চার সন্তানের জননী। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও উদ্যোগে সফল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ২০১৩ সালে অষ্টম সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার লাভ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর ডিম ফোটানোর কার্যক্রমের ওপর বিটিভি ও চ্যানেল আইয়ে প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছে। সিটি ফাউন্ডেশন থেকে এই সফল ব্যবসায়ী রাবেয়া খাতুনকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকায় তিনি আরও একটি ফার্ম করার জন্য জায়গা কিনেছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের অপূরণীয় স্বপ্ন পূরণ করতে চান। ফার্ম থেকে বর্তমানে রাবেয়া খাতুনের মাসিক আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। একদিন রাবেয়ার পায়ের নিচে মাটি ছিল না। সেই রাবেয়া আজ নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলেছেন। তাঁকে অনুসরণ করে অনেকেই নিজের জীবনকে বদলে দিতে পারেন।

যাঁরা জয়িতা হলেন
সেলিনা আক্তার শিল্পী: ক্যাটাগরি: নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী, গ্রাম: কোন্টাহাটি, উপজেলা: ধামরাই, জেলা: ঢাকা
সুফিয়া বেগম রোজী: ক্যাটাগরি: সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী, গ্রাম: নোয়াপাড়া, উপজেলা: আলফাডাঙ্গা, জেলা: ফরিদপুর
বেগম সুরাইয়া ফারুকী: ক্যাটাগরি: সফল জননী নারী, গ্রাম: পশ্চিম পাড়া দিঘুলী, উপজেলা: জামালপুর, জেলা: ঢাকা
শাহনওয়াজ দিলরুবা খান: ক্যাটাগরি: শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, গ্রাম দত্তেরগাঁও, উপজেলা: শিবপুর, জেলা: নরসিংদী, ঢাকা
রাবেয়া খাতুন: ক্যাটাগরি: অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, গ্রাম: লতিবাবাদ, উপজেলা/ জেলা: কিশোরগঞ্জ, ঢাকা


জয়িতা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি আগামীকাল ৮ এপ্রিল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হবে
তত্ত্বাবধানে: মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়
আয়