ঝুঁকি নিয়ে জরুরি সেবায় মায়েরা

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার সোনালী সেন। বাসায় ফিরে সন্তানকে ছোঁয়ার আগে তিনি হাত ধুচ্ছেন। গতকাল নিজ বাসায়
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. ইশরাত বিনতে রেজার দুই সন্তান। মেয়ের বয়স ১১ মাস। ছেলে ৩ বছর ১১ মাস বয়সী। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে গত বছর অক্টোবরে তিনি কাজে যোগ দেন। এখন অনলাইনে তাঁকে ক্লাস নিতে হয়, পাশাপাশি হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে পালা করে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ডা. ইশরাত বলেন, ‘করোনা ওয়ার্ড থেকে ফিরে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সাহস পাইনি। তাই তাকে বাজার থেকে কেনা প্রক্রিয়াজাত দুধ দিতে বাধ্য হই।’ তিনি আরও বলেন, যেসব দিনে করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পড়ে, সেদিন বাচ্চারা রাতে তাদের বাবার সঙ্গে ঘুমায়। করোনা নিয়ে শঙ্কায় তিনি বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকেন।

করোনাকালে সন্তানকে ঘরে রেখে কর্মজীবী মায়েরা যেমন চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, তেমনি ঝুঁকি নিয়ে জরুরি বিভিন্ন সেবা দিতেও কাজ করছেন তাঁরা। অবশ্য এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। তাই মায়েদের ওপর নানা ধরনের মানসিক প্রভাব পড়ছে। করোনার ভয়ে সন্তানকে সময় দিতে হচ্ছে মেপে মেপে, নানা সতর্কতা মেনে। ঘরে ফিরতেই শিশুসন্তান মাকে জড়িয়ে ধরবে, তা হচ্ছে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মা দিবস। ১৯১৪ সালে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটি সামনে রেখে বিভিন্ন পেশার কয়েকজন মায়ের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেল, তাঁদের কাজের চাপ ও সন্তান নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

দুই সন্তানের সঙ্গে ইশরাত বিনতে রেজা
ছবি: সংগৃহীত

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) সোনালী সেন সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান। তাই করোনার টিকা নিতে পারেননি। এখন তাঁকে ভারত থেকে বেনাপোল হয়ে খুলনায় আসা যাত্রীদের সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে গোসল করার পর দেড় বছর বয়সী মেয়ের কাছে যাওয়ার ফুরসত হয় তাঁর।

সোনালী সেন মুঠোফোনে বলেন, যেহেতু সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়, সেহেতু আগের মতো যখন-তখন সন্তানদের কাছে যেতে পারেন না।

সন্তানের সঙ্গে তাকিয়া ফারাহ
ছবি: সংগৃহীত

সোনালী ব্যাংকের রাজধানীর ইব্রাহিমপুর শাখার অফিসার (ক্যাশ) তাকিয়া ফারাহর ছেলের বয়স দুই বছর সাত মাস। তাকিয়াকে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিটা সব সময়ই বেশি। এখন ছেলেও বোঝে আমি অফিস থেকে ফিরেই তাকে কোলে নেব না। তাই সে অপেক্ষা করে।’

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সহযোগী অধ্যাপক তাসনিয়া হোসেইনের সংগ্রামটা একটু ভিন্ন। তাঁর যমজ দুই সন্তানের বয়স এখনো দুই বছর হয়নি। তিনি বলেন, ‘করোনায় বাসা থেকে অনলাইনে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তবে অফিস ও বাসার কাজ মিলিয়ে এখন আর অবসর বলে কিছু নেই।’

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সহযোগী অধ্যাপক তাসনিয়া হোসেইন
ছবি: সংগৃহীত

তাসমিয়া হোসেইন আরও বলেন, ‘বাসায় বয়স্ক মা–বাবা থাকেন। তাঁদের সেবা করতে হয়। করোনার কারণে খণ্ডকালীন গৃহকর্মী রাখছি না। সব দায়দায়িত্ব নিজেকেই পালন করতে হচ্ছে।’

করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯–এ নারীর চেয়ে পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি। তবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), জাতিসংঘের অধিভুক্ত সংস্থা ইউএন উইমেন এবং প্রভাবশালী জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের গবেষণা ও বিভিন্ন প্রবন্ধে বলা হয়েছে, যেকোনো দুর্যোগে নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতা-নির্যাতন বেড়ে যায়। করোনাও তার ব্যতিক্রম নয়। মহামারিতে নারীর কাজের চাপ বেড়েছে।

করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জরিপ বলছে, ৯১ শতাংশ নারীর গৃহকর্ম এবং পরিবারের সদস্যদের যত্নের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ৮৯ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁদের কোনো অবসরই নেই।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মায়েদের শারীরিক ও মানসিক চাপ কমানোর জন্য ঘরের কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব। তিনি বলেন, গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শিশুদের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার হার কম। তাই মা ও সন্তান এবং পরিবারের সদস্যরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে পারেন।

হতাশা কমাতে মায়েদের একটি পরামর্শ দেন হেলাল উদ্দীন। তিনি বলেন, মায়েরা প্রতিদিন একবার করে নিজেকে ধন্যবাদ দেবেন। নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। এতে মনে জমে থাকা হতাশা অনেকটাই কমে যাবে।