টঙ্গীতে ৩০ কিশোর গ্যাং, জড়াচ্ছে নানা অপরাধে

ছবিটি প্রতীকী

একসঙ্গে আড্ডা। এরপর রাস্তায় নারী উত্ত্যক্ত, মাদক সেবন ও মানুষকে হয়রানি। একপর্যায়ে লোকজনকে মারধর, চুরি-ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, এমনকি খুনোখুনি।
গাজীপুরের টঙ্গীতে এভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির কিশোর ও তরুণ। আর তাদের পেছনে আছেন ‘বড় ভাইয়েরা’।

২০১৩ সালে ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ‘সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ’ এলাকা টঙ্গীতে সিটি করপোরেশনের ১৫টি ওয়ার্ড। পুরো এলাকায় কতটি কিশোর দল বা অপরাধী চক্র আছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই থানা-পুলিশের কাছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকটি সরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা বলে ৩০টি ‘কিশোর গ্যাং’–এর সন্ধান পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রতিটি কিশোর দল বা বাহিনীর পেছনে আছেন এলাকার একশ্রেণির ‘বড় ভাই’। তাঁরা কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত। এই বড় ভাইদের অধীনে থাকে ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সী কিশোর ও তরুণেরা। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মানুষকে হয়রানি, মারধর বা রাজনৈতিক মিছিলে এসব কিশোর–তরুণকে ব্যবহার করেন তাঁরা।

টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলামের ভাষ্য, টঙ্গীতে প্রচুর ভাসমান মানুষের অবস্থান। অনেক সময় অপরাধীরা অপরাধ করে অন্য জায়গায় চলে যায়। এসব অপরাধীকে ধরতে তাঁরা তৎপর।

কোন এলাকায় কারা প্রশ্রয়দাতা

স্থানীয় অনেকে মতে, টঙ্গীর ‘সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ’ এলাকা বউবাজার, পূর্ব আরিচপুর ও নদীবন্দর। এখানে তুরাগ নদের পাশ ঘেঁষে হাঁটার পথ, তুরাগবাজার, ঢাকা ডাইংয়ের পেছনের দিকসহ আশপাশের এলাকায় সারাক্ষণই থাকে কিশোরদের আড্ডা। অন্তত ১৫টি দল এখানে গড়ে উঠেছে। একেকটি দলে ১০ থেকে ১২ জন করে সদস্য।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব দলের বেশির ভাগেরই নেতৃত্বে আছেন টঙ্গীর পাগাড় এলাকার মো. পারভেজ ও মনির ওরফে ব্লাকেট মনির। পাগাড় আলেরটেকের মিলন হত্যা মামলার প্রধান আসামি মনির। মিলন হত্যার ঘটনায় পরে পারভেজকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে ওই সব কিশোরের অনেকে হাবিবুর হত্যা মামলার আসামি।

প্রতীকী ছবি

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পারভেজ ও মনির বন্ধু। তাঁরা টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সোহেল রানার অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারভেজকে আমি চিনি। তবে সে আমার সঙ্গে রাজনীতি করত না। আর ব্লাকেট মনির ছাত্রলীগের এক ছোট ভাইয়ের পরিচিত। আমরা কখনোই কাউকে প্রশ্রয় দিই না।’

একইভাবে টঙ্গীর মধুমিতা, ভূঁইয়াপাড়া, জামাইবাজারসহ আশপাশের এলাকায় সজীব চৌধুরী ওরফে পাপ্পু বাহিনীর দাপট। তাঁর দলে আছে আরও অন্তত ৫ থেকে ৬টি কিশোর বা উঠতি বয়সের তরুণদের দল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অস্ত্র, মাদক, ডাকাতিসহ অন্তত পাঁচটি মামলার আসামি পাপ্পু। ২০১০ সালের দ্রুত বিচার আইনে করা একটি মামলার পাঁচ বছরের সাজা হয় তাঁর। বর্তমানে তিনি থাকেন ঢাকার বাড্ডায়। তাঁর অবর্তমানে এসব দলের নেতৃত্ব দেন তাঁর বড় ভাই বাপ্পি। তিনি একটি অস্ত্র মামলার আসামি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি পাপ্পু রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়ে টঙ্গীতে স্থায়ীভাবে ফেরার চেষ্টা করছেন। তিনি টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সরকারের অনুসারী। তবে মশিউর রহমানের দাবি, ‘আগে সে (পাপ্পু) ছাত্রলীগ করত। মাঝেমধ্যে আসত। কিন্তু এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই।’

টঙ্গী বাজার এলাকায় সক্রিয় ছিল রাফি ও নাহিদের দুটি গ্রুপ। ২০১৯ সালের ১ মার্চ দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা যায় নাহিদ। হত্যা মামলায় রাফিসহ কয়েকজন ধরা পড়লে সে গ্রুপের উৎপাত কমে। তবে টঙ্গীর ভরান এলাকায় এখনো সক্রিয় আছে মিম, জয় ও বিল্পবের নেতৃত্বে তিনটি দল। এ তিনজনই ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর করা স্কুলছাত্রী অপহরণ মামলার আসামি।

টঙ্গীর ব্যস্ততম এলাকা টঙ্গী বিসিক ও নতুনবাজার এলাকা। এ দুই এলাকায় নেতৃত্ব দেন মো. শুক্কুর আলী নামের এক ব্যক্তি। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মারধর, হত্যাচেষ্টা, চুরি, হুমকির অভিযোগে গত ১২ জুলাই টঙ্গী পূর্ব থানায় করা একটি মামলার প্রধান আসামি শুক্কুর।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে শুক্কুর ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

টঙ্গীর আরেক এলাকা এরশাদনগর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আটটি ব্লকে বিভক্ত এ এলাকায় ছোট-বড় ছয় থেকে সাতটি বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের জুয়েল ও যুবলীগের আমির হামজার উৎপাত সবচেয়ে বেশি।

টঙ্গীর কলেজগেট, সফিউদ্দিন রোড, মুক্তারবাড়ি রোড এলাকায় আছে ইব্রাহীম বাহিনীর দাপট। গত বছরের ১০ মে টঙ্গী পশ্চিম থানায় হওয়া একটি মামলার আসামি তিনি। তাঁর দলে আছে বেশ কিছু কিশোর ও উঠতি বয়সের তরুণ। বিভিন্ন সময় মারামারি বা আধিপত্য বিস্তারে এসব কিশোর–তরুণকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এর বাইরে টঙ্গীর খাঁ পাড়া, দত্তপাড়াসহ পুরো আউচপাড়া এলাকায় রয়েছে যুবলীগ নেতা বিল্লাল মোল্লার দাপট। অনেক সময় এলাকার বখাটে কিশোর বা তরুণেরা বিভিন্ন অপরাধ করতে গিয়ে তাঁর পরিচয় দেন। বিল্লাল মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও প্রায় এমন অভিযোগের কথা শুনি। তবে আমি কাউকে কখনোই প্রশ্রয় দিই না।’

কথিত বড় ভাইদের প্রশ্রয়ের বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, কেউ দলীয় পরিচয় ভাঙিয়ে এসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বা প্রশ্রয় দিলে দায়ভার তাঁরা নেবেন না। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও তৎপরতা জরুরি। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা টঙ্গী। এখানে দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মে কিশোর বা উঠতি বয়সী তরুণদের উৎপাতের অভিযোগ প্রায়ই তাঁদের কাছে আসে। তাই তাঁরাও চান এদের প্রশ্রয়দাতা বেরিয়ে আসুক।

কিছু ঘটনা

২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় টঙ্গীর মিরাশপাড়া নদীবন্দর এলাকায় একদল কিশোর-তরুণের ছুরিকাঘাতে আহত হন রিকশাচালক বাবার একমাত্র ছেলে হাবিবুর রহমানসহ (১৮) ৯ জন। পরে হাসপাতালে মারা যান হাবিবুর। বাকিরা সুস্থ হন দীর্ঘদিনের চিকিৎসায়।

সেদিন সন্ধ্যায় বাজার করতে বাসা থেকে বের হয়ে ঘটনার মধ্যে পড়ে যান মিরাশপাড়া এলাকার এক গৃহবধূ। সম্প্রতি টঙ্গীর বউবাজার এলাকায় কথা হয় ওই গৃহবধূর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০-২৫ জনকে ছোরা, চাপাতি নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। বাচ্চাকে নিয়ে কোনোরকম একটি সেলুনে আশ্রয় নিই।’
হাবিবুরকে হত্যার ঘটনায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে পরিবার। পরে ১০ জনের বিরুদ্ধ অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তাঁদের মধ্যে চারজন রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার। বাকি ৬ জন টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকার। বাকি আসামিদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় এবং গ্রেপ্তার করতে না পারায় অব্যাহিত দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা টঙ্গী পূর্ব থানার এসআই মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, টঙ্গী নদী তীরবর্তী এলাকা। এক পাশে ঢাকা, অন্য পাশে গাজীপুর। অপরাধীরা এপার থেকে ওপারে বা ওপার থেকে এপারে এসে অপরাধ করে চলে যায়।

২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাতে পাগাড় ফকির মার্কেট এলাকায় একটি কিশোর দলের ছুরিকাঘাতে খুন হয় স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. শুভ (১৫)। গত ১৫ সেপ্টেম্বর পাগাড় আলেরটেক এলাকায় ঠিক একইভাবে মহড়া দেয় ৩০ থেকে ৪০ জনের আরেকটি কিশোর দল। সেখানে ছুরিকাঘাতে খুন হন মিলন নামের এক পোশাকশ্রমিক।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আজাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আমাদের নজরে আছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের ধরা হয়। এ ছাড়া এসব অপরাধ নির্মূলে আমাদের বিস্তর পরিকল্পনা রয়েছে।’

প্রতীকী ছবি

কারা এসব কিশোর বা তরুণ

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব কিশোরের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। কারও বাবা রিকশা চালান, কারও বাবা চা বিক্রি করেন, আবার কারও মা-বাবা গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিশোরদের কেউ স্কুল থেকে ঝরে পড়া, কেউ বা স্কুলেই যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অপরাধের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ কিশোরই বিভিন্ন বস্তির। তারা বেকার থাকায় যে কেউ এসব কিশোরকে দিয়ে সহজেই অপরাধ করাতে পারছে।

টঙ্গীর নদীবন্দর এলাকায় একটি অপরাধী চক্রের প্রধান এক কিশোরের (১৬) বাবার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি টঙ্গী বাজারে চা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো ছিল। জেএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর একদিন স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি হয়। পরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে সঙ্গদোষে বখাটেপনার দিকে চলে যায়।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) গাজীপুর জেলা শাখার সদস্য ও ভাষাশহীদ কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল কুমার মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরের টঙ্গী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে প্রচুর বস্তি। অপরাধপ্রবণতাও অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে বেশি। অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কোনো না কোনো বড় ভাইয়ের মদদপুষ্ট। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা বেপরোয়া উঠছে। তিনি বলেন, এসব বড় ভাই বা তাদের প্রশ্রয় বন্ধ করতে না পারলে এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না হলে এসব অপরাধী চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।