টাকা দিলেন না মালিকেরা

মেয়ে এখনো নিখোঁজ। বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করছেন মা। রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল সে কথাই বলছিলেন। ক্ষতিপূরণ না হোক, অন্তত মেয়ের সন্ধান তাঁর চাই ষ ছবি: প্রথম আলো
মেয়ে এখনো নিখোঁজ। বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করছেন মা। রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল সে কথাই বলছিলেন। ক্ষতিপূরণ না হোক, অন্তত মেয়ের সন্ধান তাঁর চাই ষ ছবি: প্রথম আলো

পোশাকমালিকদের সমিতি বিজিএমইএ আহত ও নিহত একটি শ্রমিক-পরিবারকেও এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে পারেনি। কারণ, অধিকাংশ পোশাকমালিক বিজিএমইএর সহায়তা তহবিলে টাকা দিচ্ছেন না।
টাকা সংগ্রহ করতে বিজিএমইএর সদস্যদের সেবা বন্ধ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। ফলে আহত শ্রমিকেরা এবং নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ক্ষতিপূরণের আশায় বিজিএমইএর কার্যালয়ে ধরনা দিলেও তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলে দেওয়া হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অর্থ দেওয়া হবে। যদিও বিজিএমইএর নিজেরই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মেয়াদে দায়িত্বে থাকা সমিতির সভাপতিরা প্রত্যেকে মাত্র ১০ লাখ টাকা করে দিয়েই পার পেয়ে গেছেন। বিজিএমইএর তহবিলে সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে স্কয়ার, সিনহা, হা-মীম, শারমীন ও সানিন গ্রুপ। এই পাঁচটি গ্রুপের পক্ষ থেকে ২৫ লাখ করে মোট এক কোটি ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
সমিতির বর্তমান সভাপতি আতিকুল ইসলাম সমিতির তহবিলে দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়া সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল ইসলাম চৌধুরী পারভেজ ও আব্দুস সালাম মুর্শেদী নিজেদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। সবচেয়ে কম দিয়েছেন বিদায়ী সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি তহবিলে দেন পাঁচ লাখ টাকা।
সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘এনভয় গ্রুপের পক্ষ থেকে ১০ টাকা দিয়েছি আমরা। বিজিএমইএ থেকে এই পরিমাণ টাকাই ধরা হয়েছিল।’ এত কম টাকা কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানই তো এক টাকাও দেয়নি।’
এ ছাড়া বিজিএমইএর বর্তমান সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম পাঁচ লাখ ও সাবেক সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী ৭৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া নিট পোশাকমালিকদের সমিতি বিকেএমইএ তহবিল গঠনের শুরুর দিকে এক কোটি টাকা দেয়।
চট্টগ্রামে নিবন্ধিত প্রায় ৭৫০ পোশাক কারখানা আছে। চালু আছে ৪০০ থেকে ৪৫০ কারখানা। এর মধ্যে মান্নান গ্রুপ সবেচেয়ে বেশি—সাত লাখ টাকা দিয়েছে। সমিতির প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই বিজিএমইএর তহবিলে টাকা দিয়েছেন। তবে অধিকাংশই ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতদের গত জুনে চিঠি দিয়েছে সমিতি। এতে স্বাক্ষর করেন সভাপতি আতিকুল ইসলাম। চিঠিতে সেই সব দেশের দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যাতে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য বিজিএমইএর তহবিলে অর্থ দেয়, সে জন্য দূতাবাসকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়।
তবে এই চিঠি দিয়ে লাভ হয়নি। আজ পর্যন্ত একটি টাকাও জমা পড়েনি। উল্টো বিষয়টি জানাজানি হলে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে পোশাকমালিকদের এই সমিতি।
শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য বিজিএমইএ কোনো টাকা না দেওয়াকে ন্যক্কারজনক বলে মন্তব্য করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজিএমইএ কখনোই শ্রমিকদের স্বার্থ দেখে না। পোশাকমালিকদের বাঁচাতেই তাদের সব চেষ্টা।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত তহবিলে জমা পড়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা। বিজিএমইএর নিয়মিত তিন হাজার ২০০ সদস্যের এখন পর্যন্ত মাত্র এক হাজার ৫৫০ সদস্য তহবিলে টাকা জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ ৫২ শতাংশ সদস্যই সমিতির নির্দেশ মানেননি। অন্যদিকে বিকেএমইএর ৯০০ সদস্যের মধ্যে মাত্র অর্ধেক সদস্য তহবিলে অর্থ জমা দিয়েছেন।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে গত সপ্তাহে দুই কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছি। ক্ষতিপূরণ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেই দেওয়া হবে।’
শহিদউল্লাহ আজিম আরও জানান, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য প্রায় ৭০টি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছিল বিজিএমইএ। এখন পর্যন্ত লাবলোজ ও প্রাইমার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
সমিতির সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, সমিতির অনেক সদস্যের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তবে যাঁরা রপ্তানি করেন, তাঁদের টাকা দিতেই হবে। সে ক্ষেত্রে কেউ ছাড় পাবেন না। যেসব সদস্য টাকা দেননি, তাঁদের তালিকা তৈরি করে চিঠি পাঠানো হচ্ছে।
অনেক কারখানার পোশাকশ্রমিক ও কর্মচারীরাও রানা প্লাজা ধসে আহত ব্যক্তির সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। মালিকপক্ষের দেওয়া টাকার সঙ্গে নিজেদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ যোগ করে বিজিএমইএর তহবিলে জমা দিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আল-মুসলিম ১০ লাখ, চৈতি গ্রুপ ১০ লাখ, ইপিলিওন গ্রুপ ১০ লাখ, আজমত ফ্যাশনস চার লাখ, ফার ইস্ট ড্রেসেস তিন লাখ, জেড-থ্রি কম্পোজিট তিন লাখ, আশিয়ানা গ্রুপ দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা, ইন্টারকো ফ্যাশনস এক লাখ ৮৫ হাজার, ইন্টার ডিজাইন দুই লাখ, পারফেক্ট ফ্যাশন এক লাখ এবং মন্ডি ডি ক্যাপিটাল ১০ লাখ টাকা দিয়েছে।
২৪ নভেম্বর রানা প্লাজা ধসের দুই দিন পর বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর বিশেষ সাধারণ সভায় ভবনধসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করতে তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য দুই সমিতির প্রত্যেক সদস্যকেই তহবিলে ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা সাত দিনের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এই নির্দেশ না মানলে সদস্যদের সব ধরনের সেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে—এমন কথা জানিয়ে দেয় সমিতি।
শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক মৃত শ্রমিক এক লাখ ও স্থায়ীভাবে কর্মক্ষমতা হারানো শ্রমিক এক লাখ ২৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন।