টিকটক, অপু ভাই এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন অপু ভাইয়ে সয়লাব। তিনি টিকটক ভিডিও নির্মাতা ইয়াসীন আরাফাত অপু। আমি কখনো টিকটক কিংবা লাইকি ব্যবহার করিনি। ফেসবুকেও খুব একটা সক্রিয় নই। সে কারণে অপু ভাইয়ের ভিডিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। যতটুকু বুঝেছি, তিনি মক এন্টারটেইনার, অন্য কনটেন্টকে নিজের অভিনয়ভঙ্গিতে প্রকাশ করেন। তাঁর মতো হাজারো মক এন্টারটেইনার পৃথিবীজুড়ে রয়েছে। কেউ ফেমাস হন, কেউবা আশা করেন তাঁর ভিউজ বাড়বে, ধীরে ধীরে ফেমাস হবেন। টিকটক, লাইকি, ইউটিউব, ভিমো—এই টাইপের প্ল্যাটফর্মের মুখ্যই হচ্ছে এন্টারটেইনাররা যত বেশি ভিউয়ার আর ট্রাস্টেড ভিউয়ার (ফলোয়ার) বাড়াতে পারেন, তা ঠিক রাখা। একটা নির্ধারিত সময়ের পরে এদের অ্যাকাউন্ট মনিটাইজ শুরু হয়, এরা ভালো টাকা আয় করা শুরু করেন এসব থেকে, এটাকে প্রোফেশনাল দৃষ্টিতেও দেখতে পারেন।

এই লেখার উদ্দেশ্য অপু ভাইয়ের কাজের রিভিউ করা কিংবা কন্টেন্ট বোঝানো নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকলে বোঝা যায়, সবাই ইতিমধ্যে এসব বিষয়ে বিজ্ঞ হয়ে গেছেন।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট গল্প বলি। আমাদের পাড়ায় এক ছেলে ছিল সলিম নামের। সলিম ছোটবেলায় নাচ শেখা শুরু করেছিল মা–বাবার ইচ্ছায়। এ নাচ শেখা সলিমের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল, তার বন্ধুবান্ধব শূন্য হয়ে গেল হঠাৎ করে। আমার নিজের প্রচুর আগ্রহ ছিল নাচের প্রতি (এখনো আছে), আমিও দূরে সরিয়ে দিলাম সলিমকে। সবাই বলতে লাগল, ‘সলিম হাফ লেডিজ হয়ে গেছে’ (তখন পর্যন্ত মফস্বল শহরে ‘গে’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়নি)। এমনকি মুরুব্বিরাও তাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করল, ‘হোলা মাইন্সে নাইচবো কিল্লাই, নাচন মাইয়াগো কাম।’ আমার চোখের সামনে একটি ছেলে বেড়ে উঠল পুরো বন্ধুশূন্য হয়ে। এ ছেলেই যখন ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটি অব আর্টসে নাচ নিয়ে স্কলারশিপসহ পড়তে গেল, তার ছেড়ে যাওয়া শৈশবের বন্ধুরাই (আমিসহ) গর্বভরে তার ব্যাপারে বলতে শুরু করলাম।

এবার মূল আলোচনায় আসি, অপু ভাই এবং তাঁর অনুসারীরা রাস্তায় একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নামে থানায় মামলা হয়েছে। প্রথাগত উপায়ে তাঁদের বিচার হবে এবং হওয়া উচিত। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু গত কয়েক দিনে সামাজিক মাধ্যমগুলো ভরে গেছে অপু ভাইয়ের গ্রেপ্তার হওয়ার ছবি দিয়ে, সেখানে সবার একই মতামত, ‘এদের অবাঞ্ছিত করা উচিত’। বাকিগুলো (টিকটক, লাইকি সেলিব্রিটি(!)) কেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন না এই ধরনের পোস্টে, কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালিও করছেন দেখলাম।

অপু ভাই সম্পর্কীয় আমাদের এই রাগ–ক্ষোভ কি শুধু রাস্তা আটকিয়ে ভিডিও বানানো আর একজনের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার কারণেই?

যে দেশে প্রতি সপ্তাহে ধর্ষণ, খুন, ডাকাতির মতো শতাধিক অপরাধ সরকারি হিসাবমতেই লিস্টেড হচ্ছে, সেখানে একটি (হত্যাচেষ্টা) মামলা এত প্রায়োরিটি দিয়ে আমাদের মূল্যবান ফেসবুক পোস্ট কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।

করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা নিয়ে আমাদের এই সোচ্চার মনোভাব দেখা গেল না, খুবই আফসোসের বিষয়। নাকি এই বিদ্বেষের পেছনের কারণটুকু বর্ণবাদেরই আরেক রূপ?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট সুপ্রিমিসি, কিংবা বর্তমান ভারতের বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সোচ্চার আমাদের এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরাই যখন আবার অপু ভাই, রায়হান, হিরো আলমদেরকে নিয়ে ট্রল কিংবা হিংসাত্মক হয়ে উঠি, ব্যাপারটা খুব সাংঘর্ষিক হয়ে যায় না?

বর্ণবাদ শুধু কালো–সাদায় থাকে না, সাম্প্রদায়িকতা শুধু হিন্দু-মুসলমানে হয় না; সেলুনে কাজ করা একটা ছেলে যেকোনো মাধ্যমে যদি নিজেকে ‘পরিচিত’ করে তোলে, কিংবা ডিশ ব্যবসায়ী কেউ যদি ছ্যাবলামো করে নিজেকে হিরো বানাতে চায়, এটায় তাদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আমাদের যদি তাদের এসব উত্থানে গা জ্বলে ওঠে, তবে আমরা কোনো অংশেই কম বর্ণবাদী কিংবা কম সাম্প্রদায়িক নই।

এলিট সুপ্রিমিসি অথবা ক্যাপিটালিস্ট অ্যাপ্রোসিভ এফোর্ট শুধু মার্কেটে থাকবে, বাকি সব গোল্লায় যাক—এই ধারণা আমাদের থাকতেই পারে। এই ধারণা পোষণ করার অধিকারও আমাদের আছে। কিন্তু এই ধারণাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যখন এর বাইরের মানুষগুলোর প্রতি আমরা হিংসাত্মক হয়ে উঠি, তখন আমাদের মধ্যে আর সাদা-কালো বর্ণবাদীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য কিন্তু থাকে না।

বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা, ব্যক্তিগত পছন্দ, এন্টারটেইনার পছন্দ করার স্বাধীনতা শুধু শহরাঞ্চলের শিক্ষিত (!) কিছু মানুষের মতামতের ওপর নির্ভর করে না। পাঁচজন হোক আর পঞ্চাশ লাখ হোক, এসব অপু ভাই আর হিরো আলমের অনুসারীরাও এই দেশের নাগরিক, খুঁজে দেখলে আমার–আপনার চেয়ে এদের সংখ্যা বেশিই হবে সম্ভবত। আমাদের এই লোয়ার ক্লাস (!) গ্রোয়িং ফেস বিদ্বেষ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ। কিছুদিন পর আমাদের টেকাই দায় হয়ে উঠবে কিন্তু।

জাতি হিসেবে জাজমেন্টাল হওয়ার এই প্রবণতা আমাদের রক্তে মিশে গেছে যেকোনোভাবে। কেউ একজনের দাঁড়ি–টুপি থাকলে তাকে পিছিয়ে পড়া ভাবা, ছেলে মানুষ নাচলে তাকে হিজড়া বলে গালি দেওয়া, মিডিয়ায় কাজ করা যেকোনো নারীকে শরীর বেচে খাওয়া মনে করা, ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বললে নাস্তিক হিসেবে ট্যাগ দিয়ে দেওয়া—এসব আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কিছু করার চেয়ে বলতে বেশি পছন্দ করি।

অপু ভাই, হিরো আলমদের সস্তা কন্টেন্ট আমাদের আনন্দ না দিলে আমরা দেখব না। আমরা নিজেরা একই মাধ্যম ব্যবহার করে দামি দামি কন্টেন্ট বানাব, এটা আমাদের স্বাধীনতা। আবার ওই সব সস্তা কন্টেন্ট বানানো, ফ্যানদের এসব কন্টেন্ট নিয়ে মাতামাতি করা তাদের স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতায় তারা হস্তক্ষেপ করছে না, তারা কেউ বলেনি, আয়মান সাদিক কিংবা চয়ন ভাইয়ের কন্টেন্ট খারাপ, বলেনি যে অপুর্ব-নিশো এঁদের হিরো হিসেবে মানায় না, তাহলে আমরা কেন তাদের নিয়ে এত ইনফেরিওরিটিতে ভুগছি? একটু ভাবুন, নিজেদের স্মার্ট ভাবা আমরা সেই স্মার্টনেসেও তাদের কাছে হেরে যাচ্ছি না তো?