করোনা মহামারি
টিকা ও নিবন্ধন থেকে দূরে শহরের নিম্নবিত্তরা
শহরের বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষ টিকার নিবন্ধন কম করছেন। তাঁদের সচেতন করা ও নিবন্ধনের সুযোগ বাড়ানোর পরামর্শ।
রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি এলাকায় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের কার্যালয়। এর সামনে মনির হোসেনের ছোট চায়ের দোকান। গতকাল রোববার দুপুরে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে কথা হয় মনির হোসেন ও তাঁর দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে।
তাঁরা তিনজনই সাততলা বস্তির বাসিন্দা। মনির হোসেনের বয়স ৪১ বছর। আবদুস সামাদ ও নবিবুর রহমান দুজনেরই বয়স ৬০। জানালেন, তাঁরা ও তাঁদের তিনজনের পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। বললেন, বস্তিতে করোনা নেই।
কেউ কি করোনার টিকা নিয়েছেন—এমন প্রশ্নে তিনজনেরই উত্তর, ‘না’। কেন টিকা নেননি? এর উত্তরে চায়ের দোকানি মনির হোসেন বলেন, ‘ছোডবেলায় টিকা নিছি। হাতে দাগ আছে। আর টিকার দরকার নাই।’ নবিবুর রহমান ও আবদুস সামাদ বলেন, কেউ তাঁদের টিকা নিতে বলেনি। তাঁরা শুনেছেন টিকা নেওয়ার কাগজপত্র তৈরিতে নানা জটিলতা আছে।
—ঢাকা দক্ষিণ সিটি নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে কাউন্সিলরদের চিঠি দিয়েছে। যদিও চালু হয়নি।
—টিকা নিতে যাওয়া মানুষ মূলত অগ্রাধিকার তালিকার অথবা শিক্ষিত ও সচ্ছল।
সাততলা বস্তিতে গতকাল আরও ১০ জন বয়স্ক নারী-পুরুষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের প্রত্যেকের বয়স ৫০ বছরের বেশি। তাঁরা কেউ টিকা নেননি, টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধনও করেননি। একটি ছোট কম্পিউটারের দোকানে বসে থাকা একজন যুবক জানালেন, এ এলাকায় শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাতে কর্মরত ব্যক্তিরাই টিকা নিচ্ছেন। বস্তির কেউ টিকা নিয়েছেন, এমন কথা তিনি শোনেননি।
এটা শুধু ঢাকার চিত্র নয়। চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে বিভিন্ন নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা দেখেছেন, টিকার ব্যাপারে পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্য তাঁদের কাছে নেই। নিবন্ধনও কম।
টিকাদান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যায্যতা দেখা যাচ্ছে। মহানগর, জেলা সদর ও উপজেলা সদরে টিকা পাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা, সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারী ও শিক্ষিতরা। মূলত নিবন্ধন করার সুযোগ যাঁদের আছে তাঁরা পাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত, বস্তির মানুষ, নিরক্ষর এবং গ্রামের অতি বয়স্ক মানুষ এ সুযোগ পাচ্ছেন না।’
দরিদ্র মানুষ যাতে টিকা পায়, এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৭৫টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে প্রযুক্তিগত সহায়তার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে গণটিকাদান শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রতিবেদক ঢাকার সাতটি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন। এসব হাসপাতালে টিকা নিতে চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী ও তাঁদের নিকটজন এবং উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত মানুষদেরই বেশি দেখা গেছে।
সরকারি উদ্যোগে ঘাটতি
করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করা যাচ্ছে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে। নিবন্ধনের জন্য গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে কিছু ক্ষেত্রে নিবন্ধনে সহায়তা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্রতম মানুষ সেই সুযোগ পাচ্ছেন কি না, তা সরকারিভাবে তলিয়ে দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই।
গ্রামের মানুষের তবু ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে, শহরের বস্তি বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সেই সুযোগও নেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও করোনা মিডিয়া সেলের মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শহরের মানুষের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনগুলোর। এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্যোগী হতে হবে।
সিটি করপোরেশন কী করছে তা জানতে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দরিদ্র মানুষ যাতে টিকা পায়, এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৭৫টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে প্রযুক্তিগত সহায়তার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কাউন্সিলররা কী প্রস্তুতি নিচ্ছেন, জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খ ম মামুন রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, বুথ খোলার জন্য তাঁরা ৭ থেকে ১০ দিন আগে চিঠি পেয়েছেন। সেখানে করোনার টিকার জন্য নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। জনবল না থাকলে তো রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না।
দক্ষিণ সিটির ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মাসুদ বলেন, গত বৃহস্পতিবার চিঠি পেয়েছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সপ্তাহ থেকে কার্যক্রম চালু করবেন।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, মসজিদকেন্দ্রিক একটি প্রচারণা আছে। মাইকিংয়ের প্রস্তুতি আছে, তবে এখনো তাঁরা অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার তা শুরু করতে পারেননি।
সবার সুযোগ নেই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের কর্মকর্তারা গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে সহজ। পাঁচ মিনিটে নিবন্ধন শেষ করা যায়। ইতিমধ্যে নিবন্ধন করেছেন, এমন অনেকেই বলেছেন, নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি তেমন জটিল নয়।
তবে সমস্যা হচ্ছে, নিবন্ধন করার জন্য কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ বা ইন্টারনেট সংযোগসহ মুঠোফোন সবার নেই। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, দেশে গত ডিসেম্বর শেষে ইন্টারনেট গ্রাহক দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ কোটি ১৯ লাখে। অবশ্য ৯০ দিনে একবার ব্যবহার করলেই একজনকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করে বিটিআরসি।
মুঠোফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমের ‘মোবাইল ইকোনমি ২০২০: এশিয়া-প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশের হাতে মুঠোফোন রয়েছে। এটি মূলত ‘ইউনিক ইউজার’, যার মানে হলো এ ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির একাধিক সিম (গ্রাহক শনাক্তকরণ নম্বর) থাকলেও তাঁকে একজন গ্রাহক হিসেবেই ধরা হয়। জিএসএমের হিসাবে, মোট ইউনিক ইউজারের ২৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনসংখ্যার হিসাব বিবেচনায় নিলে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ২৪ লাখে। সব মিলিয়ে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে।
সরকার ৪০ বছর বয়সী সব নাগরিককে টিকা দেবে। এই বয়সী মানুষ আছে প্রায় সাড়ে চার কোটি। গতকাল বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধন করেন ১৭ লাখের কিছু বেশি মানুষ। গতকাল সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন। এই সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ২৫ হাজার ১৮ জন কম।
জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ বলেন, বস্তিতে করার অভিজ্ঞতা অনেক এনজিওর আছে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও নিবন্ধন করার কাজে সরকার এখন এনজিওগুলোকে মাঠে নামাতে পারে।