টি–ব্যাগটাই যখন ক্যানভাস

টি–ব্যাগের ক্যানভাসে পাতাকা তুলে ধরেছেন মো. সাদিত উজ জামান
ছবি: সংগৃহীত

কালো কোট, কালো মোটা ফ্রেমের চশমার ছবি দেখলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি চোখে ভাসে। দুটি টিয়া পাখি মনের আনন্দে উড়ছে, আর একটি টিয়া খাঁচায় বন্দী। এ ছবিতে স্বাধীনতার যে আকুলতা, তা–ই প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ, ১৯৭১ সালের পত্রিকা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, জাতীয় পতাকা, বাংলা অক্ষর, জেলহত্যা দিবস, সবুজ মলাটের পাসপোর্ট, বাংলার বেঙ্গল টাইগার, জামদানি, রমনার বটমূল, ইলিশ, শিমুল-পলাশ ফুলসহ বিভিন্ন ছবি চোখের সামনে পুরো বাংলাদেশকেই তুলে ধরে। এভাবে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলা বা পুরো বাংলাদেশকে চায়ের ব্যবহৃত ব্যাগ বা টি–ব্যাগের ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন মো. সাদিত উজ জামান।

সাদিত এ পর্যন্ত ৪০০টির বেশি ছবি এঁকেছেন ব্যবহৃত টি–ব্যাগে। সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ছবিতেই বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই তরুণ বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আবেগের জায়গা। বাংলাদেশকে বুঝতে হলে বা বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তুলতে হলে বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধকে জানতে ও বুঝতে হবে। আবেগের পাশাপাশি এই জিনিসগুলো চায়ের ব্যাগের মতো ছোট ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার কাজটিও জটিল। এ ধরনের কাজে ইতিহাস জানা, অবয়ব ঠিক রাখাসহ সব বিষয়েই বেশি সচেতন থাকতে হয়। তবে এখন পর্যন্ত আমার ছবিতে কোনো ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি।’

আঁকাআঁকিটা কখনোই কারও কাছে শেখেননি সাদিত। স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসেই বলতে গেলে হাতেখড়ি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাদিত টি–ব্যাগে আঁকা ছবি পোস্টের সময় ছবিটির ইতিহাস বা কোন প্রেক্ষাপট থেকে ছবিটি এঁকেছেন, তা–ও লিখে রাখেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন দিন ধরেও এঁকে চলেছেন নতুন নতুন ছবি। ফলে ছবিগুলো বা ছবির গল্পগুলো অনেকটা ডায়েরির পাতার মতো ঘটনা লিপিবদ্ধ করে রাখছে। ‘টি-ব্যাগ স্টোরিজ’ নামে ফেসবুকেও একটি পেজ রয়েছে।
সাদিত বললেন, ‘আমার কাজের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের কাছে নতুন করে তুলে ধরতে চাই। আমার জানামতে, বাংলাদেশে চায়ের ব্যাগে এ ধরনের কাজ আগে হয়নি, তাই শিল্পাঙ্গনে জায়গা করে নিতে পারলে এটি ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।’ রুবি সিলভিয়া নামের মার্কিন একজন শিল্পী সাদিতকে অনুপ্রাণিত করেছেন চায়ের ব্যাগের ক্যানভাসে কাজ করতে।

সাদিত শুধু টি–ব্যাগ নয়, বিভিন্ন রিসাইকেল বা ফেলে দেওয়া জিনিসকেও ক্যানভাস বানাতে পছন্দ করেন। সাদিত জানালেন, তাঁর দাদির কাজও তাঁর ব্যতিক্রমী কাজের ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। দাদি নিজেও কোনো গাছের বীজ, বড় মাছের আঁশ, মাটির পাত্র দিয়ে নানা রকম জিনিস বানান, একইভাবে এগুলো যাতে সাদিত ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, সে চিন্তা থেকেও তিনি তা যত্ন করে জমিয়ে রাখেন।

টি–ব্যাগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে
ছবি : সংগৃহীত

গল্পে গল্পে সাদিত তাঁর টি–ব্যাগে ছবি আঁকার কাজটি স্থায়ী হওয়ার পেছনে তাঁর খালা নূর ই হাফজা পারভিনের নামও উল্লেখ করলেন। বেতার ও মঞ্চশিল্পী এ খালাও অব্যবহৃত জিনিস দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানান।

চা পানের পরে চায়ে ডোবানো টি–ব্যাগ অন্যরা ফেলে দেন। আর রাজশাহীর সাদিত, তাঁর পরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকে টি–ব্যাগগুলো যত্ন করে রেখে দেন। ভেজা থাকা অবস্থায় ভেতর থেকে চা–পাতা ফেলে দিয়ে অথবা ছবির প্রয়োজনে গাঢ় করতে হলে পাতাসহ টি–ব্যাগ রোদে শুকানো হয়। তারপর পাতা ফেলে তাই ক্যানভাসে পরিণত করা হয়। এ ক্যানভাসে ছবি আঁকতে খরচ খুবই কম, তবে সময় এবং মনোযোগ লাগে অনেক বেশি। অনেক সময় কয়েকটি টি–ব্যাগের আলাদা ছবি মিলে একটি ছবি তৈরি করেন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন সাদিত।

প্রদর্শনীতে একেকটি ছবি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আঁকাআঁকিটা কখনোই কারও কাছে শেখেননি সাদিত। স্কুলের ড্রয়িং ক্লাসেই বলতে গেলে হাতেখড়ি। সাদিত মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে বিবিএ এবং এমবিএ করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। বর্তমানে রাজশাহীতে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফ্যাশন হাউস ‘সুন্দর’ নিয়েই আছেন।

আঁকাআঁকির পেছনে পরিবারের ব্যাপক ভূমিকা আছে বলে জানালেন সাদিত। জানালেন, তাঁর পরিবার সব ক্ষেত্রেই জীবনকে উপভোগ করতে শিখিয়েছে। কখনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি; বরং সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ব্যবসায়ী বাবা মো. ফরহাদুজ্জামান সুন্দর স্কেচ করতে পারেন। মা ২৬ বছর ধরে স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। ছোট দুই বোন স্নেহা ও সুহানা পড়াশোনা করছেন। কোনো আঁকা শেষ হলে পরিবারের সদস্যদের দেখান বা আঁকার আগেই তাঁদের মতামত নিয়ে কাজ করেন সাদিত।

সাদিতের টি–ব্যাগ চিত্র
ছবি : সংগৃহীত

টি–ব্যাগের ছবি ও গল্পগুলো এখন পর্যন্ত সাদিতের ব্যক্তিগত সংগ্রহেই আছে। একক প্রদর্শনী করার ইচ্ছা থাকায় কিছু ফ্রেম করে আর কিছু অ্যালবাম করে রেখেছেন। ঢাকায় শিল্পকলায় পেনসিল ফাউন্ডেশনের, রাজশাহীর ইংক্টোবারের প্রদর্শনীতে এবং ময়মনসিংহ কার্টুন ফেস্টে সাদিতের ছবি স্থান পেয়েছে। এর বাইরে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইস্পাহানি মির্জাপুর, কাজী অ্যান্ড কাজী টি, রূপালী ইনস্যুরেন্স কোম্পানিসহ বিভিন্ন কোম্পানির প্রচার ও ক্যালেন্ডারে, বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদেও স্থান পেয়েছে নানা ছবি। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটির জন্য একটি ছবি এবং তুরস্কের টি–ব্যাগ ফিল্টার পেপার উৎপাদন কোম্পানি পেলিপেপারের ক্যাটালগেও জায়গা করে নিয়েছে চায়ের ব্যাগের গল্প।
সাদিত বললেন, ‘আমি আমার আঁকা ছবি কাউকে উপহার দিই না বা কারও ব্যক্তিগত অনুরোধেও আঁকি না। অনেক সময় কিছু কোম্পানি বিনা পারিশ্রমিকে বা খুব সামান্য সম্মানীতে কাজ করাতে চায়, যা মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’