টিসিবির লাইনে হঠাৎ দেখা মা ও দুই মেয়ের

টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসে হঠাৎ দেখা মা সুফিয়া বেগম (মাঝে), মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন (বাঁয়ে) ও লিপা আক্তারের। গতকাল উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টর মাঠে
ড্রিঞ্জা চাম্বুগং

সুফিয়া বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন ও লিপা আক্তার। এই তিন নারীর পরিচয় প্রথমজন মা, বাকি দুজন বোন। তিনজনেরই আলাদা সংসার। মা থাকেন উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে লিপা থাকেন আধা কিলোমিটার দূরে সেক্টরের বাইরে। আর বড় মেয়ে সাবিনা থাকেন সেক্টর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে পাকুরিয়া এলাকায়। গতকাল সোমবার দুপুরে মা ও দুই মেয়ের হঠাৎ দেখা হয়ে যায় উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের খেলার মাঠে।

তিনজনই সেখানে যান টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাক থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে। এভাবে দেখা হয়ে যাবে, সেটি তাঁরা কেউ আগে থেকে জানতেন না।

কেনা দাম ১৫৪ টাকা ৪২ পয়সা। বিক্রি করছি ১৫৫ টাকায়। সামনে কম দামের তেল বাজারে আসবে
বিক্রেতা মো. পলাশ

সুফিয়া বেগম উত্তরার একটি অফিসে খাবার রান্না করেন। তাঁর স্বামী শাহেদ আলী ডাব বিক্রি করেন। সাবিনা গৃহিণী, তাঁর স্বামী আইয়ুব আলী স্যানিটারি মিস্ত্রি। দৈনিক আয় ৬০০ টাকা। লিপাও গৃহিণী, তাঁর স্বামী আবদুল সালাম একটি কোম্পানির বিক্রয়কর্মী। বেতন মাসে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। সাবিনার এক মেয়ে ও এক ছেলে। লিপার এক ছেলে।

আরও পড়ুন

মা ও দুই মেয়ের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন বেলা প্রায় একটা। টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে সাড়ে ১১টার দিকে প্রথমে আসেন বড় মেয়ে সাবিনা। কিছুক্ষণ পর তাঁর দেখা হয় ছোট বোন লিপার সঙ্গে। ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা দুই বোন যখন গল্প করছিলেন, হঠাৎই দেখতে পান সেখানে তাঁদের মা–ও এসেছেন।

মা সুফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চারজনের সংসার। এর মধ্যে তিনজনই (তিনি নিজে, স্বামী ও এক ছেলে) রোজগার করেন। তবু সংসার চলে না। কয়েক দিন ধরে তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। চিকিৎসার খরচও যোগ হয়েছে। এর আগে কখনো টিসিবির লাইনে দাড়ানো হয়নি তাঁর।

আরও পড়ুন

অসুস্থ শরীর নিয়ে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে মা পণ্য কিনবেন, এটি ভেবে খারাপ লাগছিল বড় মেয়ে সাবিনার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাকে একটু যে সাহায্য করব, সেই উপায়ও আমার নাই। আমার স্বামীর তিন দিন কাজ থাকে তো দুই দিন থাকে না। কী যে একটা অবস্থা!’

মাসখানেক আগে মায়ের বাসায় গিয়ে কয়েক কেজি আটা দিয়ে এসেছেন বলে জানালেন ছোট মেয়ে লিপা। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, গত কয়েক মাস ওএমএস (খাদ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন খোলাবাজারে বিক্রি কার্যক্রম। চালের কেজি ৩০ টাকা) থেকে চাল কিনছেন তাঁরা। আর তেল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি কেনেন টিসিবি থেকে। কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও টিসিবি থেকে কিনলে কিছুটা সাশ্রয় হয়। তিনি জানান, তাঁর এক সন্তান, বয়স প্রায় দেড় বছর। ছেলেকে বাসায় একা রেখে অন্য কোথাও কাজ করা এখন তাঁর জন্য কঠিন হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

দুই বোন কথায় কথায় জানালেন, সংসারের খরচ কুলাতে না পেরে তাঁদের মেজ বোন সালমা ঢাকা ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা চলে গেছেন। সালমার স্বামী আশরাফুল এখন একটি মেসে থাকছেন।

মা ও দুই মেয়ের সঙ্গে কথা আর এগোল না ট্রাক চলে আসায়। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে গতকাল টিসিবির ট্রাক যখন এসে পৌঁছায়, ততক্ষণে বেলা প্রায় দুইটা। ট্রাক থামে মাঠের ঠিক সামনে। আর মা–মেয়েরা অপেক্ষা করছিলেন মাঠের পেছনের দিকে। দূর থেকে ট্রাক দেখেই অন্যদের সঙ্গে তাঁরাও সেদিকে ছুটে যান। তবে অসুস্থ শরীর নিয়ে সুফিয়া ও কোলে সন্তান নিয়ে সাবিনা কিংবা লিপা কেউই জোরে হাঁটতে পারেননি। ফলে নারীদের লাইনে তাঁদের জায়গা হয় সবার পেছনে।

তবে ট্রাক দেরিতে আসায় বিক্রির শুরুতে ভিড় কম ছিল। নারীদের লাইনে ছিল ৩১ জন ও পুরুষদের লাইনে ছিল ২৭ জন। মা–মেয়েরা পণ্য কেনার সুযোগ পান বেলা তিনটার দিকে।

আরও পড়ুন

উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে গতকাল টিসিবির পণ্য নিয়ে যান পরিবেশক মেসার্স মিশাল এন্টারপ্রাইজ। ট্রাকে ছিল ১ হাজার কেজি করে ছোলা ও পেঁয়াজ, ৫০০ কেজি করে মসুর ডাল (মোটা দানা) ও চিনি এবং ২৫০ বোতল (দুই লিটারের বোতল) সয়াবিন তেল। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি পেঁয়াজ, চার কেজি ছোলা, দুই কেজি করে মসুর ডাল ও চিনি এবং এক বোতল সয়াবিন তেল কিনতে পারেন। বিক্রেতারা পণ্যগুলো প্যাকেজ আকারে বিক্রি করেন। সব পণ্যের একটি প্যাকেজের দাম ৮১০ টাকা।

টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজের সঙ্গে ছোলা যুক্ত হওয়ায় ট্রাকে পণ্য ওঠাতে অন্য দিনের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট বেশি সময় লেগেছে। আর রাস্তার যানজটের কারণেও ট্রাক আসতে দেরি হয়েছে।

বিকেল চারটার দিকেও সেখানে পণ্য বিক্রি হচ্ছিল, তখন নারীদের লাইনে ৯৭ জন ও পুরুষদের লাইনে ৭৮ জন দাঁড়ানো ছিলেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়ছিল।

গত রাত আটটায় বিক্রেতা শরিফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য না পেয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষ ফিরে গেছেন। বিক্রি শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।

সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে কেনা দামে

সরকার গত রোবার প্রতি লিটারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৮ থেকে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের দাম ৩৫ টাকা (লিটারে সাত টাকা) কমিয়ে ৭৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে। খোলা সয়াবিনের ক্ষেত্রে লিটারে সাত টাকা কমিয়ে নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে ১৩৬ টাকা।

তবে বিক্রেতারা বলছেন, ভোক্তাপর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হতে আরও কয়েক দিন লাগতে পারে। এর কারণ কোম্পানিগুলো নতুন দরে পণ্য এখনো বাজারজাত শুরু করেনি।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচতলার মুদিদোকান আবদুর রব এন্টারপ্রাইজে গতকাল প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৫৫ টাকায় বিক্রি হয়। বিক্রেতা মো. পলাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেনা দাম ১৫৪ টাকা ৪২ পয়সা। বিক্রি করছি ১৫৫ টাকায়। সামনে কম দামের তেল বাজারে আসবে।’