টেলিযোগাযোগ প্রকল্পের কাজ নিয়ে টানাহেঁচড়া চলছেই

সরকারের মেয়াদ শেষ হতে চললেও টেলি-যোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপনের ৪০০ কোটি টাকার সেই কাজ (লট-এ) নিয়ে টানাহেঁচড়া শেষ হচ্ছে না। ‘পছন্দের’ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে বেপরোয়া বিটিসিএল ইতিমধ্যে ফাইল প্যাঁচাপেঁচি করেই প্রায় দুই বছর পার করে দিয়েছে। লট-এ ও লট-বি নিয়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প এটি। 
সর্বশেষ নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে এক দিনের মধ্যে লট-এ-এর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেয় বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ-সংক্রান্ত বিল অব কোয়ানটিটি (বিওকিউ) কমিটি মনে করে, এই নির্দেশ অন্যায্য। এ নিয়ে কমিটির প্রধান পদত্যাগও করেছেন।
এই প্রকল্পের কাজের বিষয়ে হাইকোর্টের দুটি রিটের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আবার মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও এখন মানা হচ্ছে না। মতামত না নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের খসড়া তৈরির চাপ দেওয়া হয়।
এর আগে আংশিক তথ্য উপস্থাপন করে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ নিয়ে ১২ জুন প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিনই এ পরিচালনা পর্ষদের ৯১তম সভায় এ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের দুটি রিটের (নম্বর-৫০৭৩/১২ ও ৫০৯৫/১২) ওপর পুনরায় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মতামতের জন্য যথারীতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নথিও পাঠানো হয়।
মতামত পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কলিমুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না।’
তবে আইন মন্ত্রণালয়ের দাযিত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত সোমবার পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত মতামত চেয়ে কোনো নথি যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, মতামতসংক্রান্ত নথিটি এখনো ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য অপেক্ষা না করেই লট-এ-এর কাজ মারুবেনি-কেটি নামক একটি যৌথ উদ্যোগের কোম্পানিকে দিতে চুক্তির খসড়া তৈরি করার জন্য গত ১৭ জুন বিওকিউ কমিটির আহ্বায়ককে নির্দেশ দেয় বিটিসিএল। ২০ জুন বিওকিউ কমিটিতে এক দিনের মধ্যে চুক্তির খসড়া তৈরি করে পাঠাতে নির্দেশ দেন বিটিসিএলের এমডি এম কলিমুল্লাহ। তাতে অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে জাপানি ইয়েনের জায়গায় মার্কিন ডলারে পরিশোধের বিষয় উল্লেখ করতে বলা হয়। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, জাপানি মুদ্রা ইয়েনে দরমূল্য প্রস্তাব করা ও বিল পরিশোধের কথা। প্রকল্পটি জাপানি ঋণে বাস্তবায়নের কথা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ডলারে বিল পরিশোধ করলে সর্বশেষ মুদ্রা বিনিময় হার অনুযায়ী রাষ্ট্রের ৯০০ মিলিয়ন ইয়েন বা ৭২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়। ডলারে বিল পরিশোধের কথা উল্লেখ করে চুক্তির খসড়া তৈরি করতে রাজি হয়নি বিওকিউ কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক শাহীদুল আলম গত ২৩ জুন বিটিসিএলের এমডির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।
জানতে চাইলে এমডি এম কলিমুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিওকিউ কমিটির আহ্বায়ক পদত্যাগ নয়, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। শাহীদুল আলম কেন অব্যাহতি চেয়েছেন, তার কোনো কারণ উল্লেখ করেননি বলে দাবি করেন এমডি।
তবে নথিপত্রে দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট তিনটি কারণ উল্লেখ করে পদত্যাগ করেন শাহীদুল আলম। সেগুলো হলো এক. পরিচালনা পর্ষদের ৯১তম সভায় লট-এ ও লট-বি-এর সম্পৃক্ততার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের স্পষ্টীকরণ সংগ্রহের জন্য বিটিসিএলকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেটা পাওয়া যায়নি।
দুই. বিদেশ মুদ্রা পরিশোধের (ইয়েনের পরিবর্তে ডলার) বিষয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় বলেছে, এটা তাদের কাজের মধ্যে পড়ে না, এটা বিটিসিএল করতে পারে। কিন্তু ৯১তম পর্ষদ সভায় এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিন. আলোচ্য প্রকল্পের ক্রয়প্রস্তাব অনুমোনদনকারী কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু কোন মুদ্রায় বিল পরিশোধ হবে এবং চুক্তিমূল্য কী হবে, সে ব্যাপারে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
‘এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে’ বিওকিউ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনায় ‘অপারাগতা’ প্রকাশ করে পদ থেকে অব্যাহতি চান শাহীদুল আলম।
শাহীদুল আলমের ওই অব্যাহতিপত্রেই বলা হয়েছে, এ-বিষয়ক একটি খসড়া চুক্তি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিচালক (সংগ্রহ) দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে।
ওই খসড়ায় দরপত্রের শর্তানুযায়ী, বিল পরিশোধ মুদ্রা ইয়েন উল্লেখ ছিল। সেই খসড়া গ্রহণ করলে মারুবেনি-কেটিকে কাজ দেওয়া যায় না। এ কারণে আবার খসড়া চাওয়া হয়।
টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন এক্সচেঞ্জ স্থাপন (লট-এ) ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন স্থাপনের (লট-বি) কাজের জন্য ২০১১ সালে প্রাকেযাগ্যতার একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দুটি ছাড়া অংশগ্রহণকারী বাকি সব প্রতিষ্ঠানকে প্রাকেযাগ্যতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। প্রাকেযাগ্য প্রতিষ্ঠান দুটি হলো মারুবেনি-কেটি ও জাপানের এনইসি করপোরেশন। গত বছরের জুনে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লট-এ-এর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি মারুবেনি-কেটিকে লট-এ-এর কাজ দেওয়ার চিঠি (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) দেওয়া হয়।
এই মারুবেনি-কেটিকেই ২০০ কোটি টাকার লট-বি-এর কাজও দেওয়ার জন্য সব নিয়ম, আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে বিটিসিএল। এই অনিয়ম ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।