ট্যানারির বর্জ্য গোপনে ফেলা হয় নদীতে

রাতে পাইপ বসিয়ে বর্জ্য পরিশোধনাগার থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। দিনে সরিয়ে ফেলা হয় সেই পাইপ।

  • ট্যানারি কেন বন্ধ হবে না জানতে চেয়ে বিসিককে চিঠি পরিবেশ অধিদপ্তরের।

  • মালিকেরা বলছেন, বিসিকের ব্যর্থতায় তাঁরাও ডুবছেন।

সাভারের চামড়াশিল্প নগর থেকে রাতের আঁধারে ট্যানারির তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই অভিযোগের পর গত সোমবার রাতে গিয়ে দেখা যায়, শিল্পনগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) থেকে পাইপ বসিয়ে তরল বর্জ্য ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে।

শিল্পনগরের চামড়া পরিশোধনের কারখানা বা ট্যানারিতে উৎপাদিত চামড়ার তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলার কথা। এ জন্য প্রায় ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সিইটিপি করা হয়েছে। আর নদীদূষণ ঠেকাতেই রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে চামড়াশিল্প নগরে নেওয়া হয়েছিল।

চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। শিল্পনগর প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক ও বিসিকের মহাব্যবস্থাপক জিতেন্দ্র নাথ পাল প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবার বিষয়টি জেনে তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। তাঁরা ভিন্ন একটি কারণ বলেছিলেন। রাতে আবার বর্জ্য ফেলার কাজটি করা হলে সেটি হবে খুবই দুঃখজনক। তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

চামড়াশিল্প নগরের এক পাশে ধলেশ্বরী নদীর তীরে সিইটিপি অবস্থিত। নদীর তীরে বাঁধের পাশে চামড়াশিল্প নগরের সীমানাদেয়াল। গত সোমবার রাতে গিয়ে দেখা যায়, সিইটিপি–ঘেঁষা দেয়াল ফুটো করে দুটি পাইপ বসানো। সেই পাইপ দিয়ে বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, পাইপ দুটি নেই।

এর আগে গত সোমবার এই প্রতিবেদক চামড়াশিল্প নগরে গিয়েছিলেন। তখন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক জেলে রাতে বর্জ্য নদীতে ফেলার অভিযোগটি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় পানি দূষিত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই মাছ ও শুশুক মরে ভেসে ওঠে। নদীতে এখন মাছও তেমন একটা পাওয়া যায় না।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে গিয়ে ধলেশ্বরী মরছে

ট্যানারিগুলো একসময় নারায়ণগঞ্জে ছিল। ১৯৫১ সালের ৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ট্যানারি ঢাকার হাজারীবাগে আনা হয়। হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো দিনে প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলত। এ ছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধের পাশে, খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলা হতো।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেয়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৭৬ কোটি টাকা, যা পরে বাড়তে বাড়তে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একরের কিছু বেশি জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট দেওয়া হয়।

চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, ২৫০ কোটি টাকা ট্যানারির মালিকদের ক্ষতিপূরণ এবং বর্জ্য পরিশোধনাগার, চামড়া উচ্ছিষ্ট ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ ও অন্যান্য কাজের জন্য রাখা হয়েছিল ৬৫০ কোটি টাকার মতো।

জমি দেওয়ার পর বিভিন্ন সময় বিসিক ট্যানারির মালিকদের সাভারে যাওয়ার সময় বেঁধে দেয়। তবে ট্যানারির মালিকেরা গরজ দেখাননি। তাঁরা বারবার বলছিলেন, সিইটিপি প্রস্তুত নয়।

সিইটিপি নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ১১ মার্চ একটি চীনা কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয় বিসিক। দরপত্র মূল্য ছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৪৭ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। কাজ শেষের সময় ধরা হয়েছিল ১৮ মাস। আর ছয় মাস রাখা হয়েছিল সিইটিপি কার্যকর করে বুঝিয়ে দেওয়ার। কিন্তু চীনা ঠিকাদার কোম্পানি সিইটিপির কাজ শেষ করতে সময় নেয় ৯ বছরের বেশি। যদিও শেষ পর্যন্ত সিইটিপি যথাযথ মান অনুযায়ী হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় হাজারীবাগের কারখানার সেবা–সংযোগ। সাভারে চামড়াশিল্প নগরে ট্যানারি চালু হতেই পরিবেশদূষণের অভিযোগ ওঠে।

সর্বশেষ গত ২৭ জুন চীনা ঠিকাদার সিইটিপি বিসিককে হস্তান্তর করে। এরপর এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাওয়ার কথা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির কাছে। এই কোম্পানি বিসিক ও ট্যানারির মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত। ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, তাঁরা কোম্পানির দায়িত্ব বুঝে নিতে ট্যানারিগুলোর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করার শর্ত দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সাভারে চামড়াশিল্প নগরে উৎপাদনে থাকা ১৪৪টি ট্যানারির একটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।

এদিকে গত সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, সিইটিপির পাশে বিশাল এক আস্তাকুঁড়ে চামড়ার উচ্ছিষ্ট ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই আস্তাকুঁড়ের পাড় ভেঙে প্রায়ই বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। পুরো এলাকায় চামড়ার উচ্ছিষ্ট পচে উৎকট গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।

কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের পাশে নদীর পাড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে ডাম্পিং জোনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে বর্জ্য। গত সোমবার দুপুরে।
ছবি: শামসুজ্জামান

সিইটিপি ‘অকার্যকর’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চামড়াশিল্প নগরে এখন প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সিইটিপির পরিশোধন সক্ষমতা দিনে ২৫ হাজার ঘনমিটার। এই ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্যও ঠিকমতো পরিশোধন হয় না।

সিইটিপি যে ‘অকার্যকর’, তা উঠে এসেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শনে। গত ২৯ আগস্ট ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি চিঠি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে বলা হয়, গত ১২ জুলাই তারা সিইটিপি পরিদর্শন করে। এ সময় দেখা যায়, সিইটিপি অকার্যকরভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নালা দিয়ে নদীতে ফেলা হচ্ছে।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, সিইটিপিতে পরিশোধন করার পর যে পানি নদীতে ফেলা হয়, তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বর্জ্য সঠিকভাবে পরিশোধন করা হচ্ছে না। এতে নদীর জলজ জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এটি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।

এর আগে গত বছর নভেম্বরে নদীদূষণের দায়ে সাভারের চামড়াশিল্প নগরকে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা ৫০ হাজার জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বিসিক জরিমানার টাকা পরিশোধ না করে আপিল করেছে।

শিল্পনগর বন্ধ নিয়ে চিঠি

জাতীয় সংসদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গত ২৩ আগস্ট পরিবেশদূষণের দায়ে চামড়াশিল্প নগরের ট্যানারি সাময়িক বন্ধের সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ৯ সেপ্টেম্বর বিসিকের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেয়।

চিঠিতে বলা হয়, সংসদীয় কমিটি ট্যানারি বন্ধের সুপারিশ করেছে। আইন অনুযায়ী পরিচালিত হলে ট্যানারি আবার চালু করার কথা বলা হয়েছে। বন্ধের আগে জরিমানার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুপারিশও করা হয়েছে। চিঠিতে ট্যানারি কেন বন্ধ করা হবে না, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মাসুদ হাসান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিসিকের কর্মকর্তারা ৬ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরে এসে বলেছে, দূষণ বন্ধে ১৫ দিনের মধ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা দেবে। আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

দোষাদুষিতে দুই পক্ষ

দেশের রপ্তানি আয়ে চামড়া ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। সর্বশেষ ২০২০–২১ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় কমে ৯৪ কোটি ডলারে নামে। অথচ কথা ছিল, পরিবেশসম্মত শিল্পনগরে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পণ্য বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড কিনবে। ট্যানারিগুলো পাবে বৈশ্বিক জোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) পরিবেশসম্মত কারখানার সনদ।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডব্লিউজি তো দূরের কথা। আমাদের নিয়মিত ক্রেতারাই পালিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। সিইটিপি কার্যকর না হওয়ার দায় তো আমাদের নয়। এটা নির্মাণ করেছে বিসিক। এখন কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তার কর্মপরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন দরকার।’

ওদিকে বিসিকের চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের মহাব্যবস্থাপক জিতেন্দ্র নাথ পাল অভিযোগের আঙুল তোলেন ট্যানারির মালিকদের দিকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মালিকেরা বর্জ্য নির্গমনের নিয়ম মানেন না। শিল্পনগরের ভেতরে পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করলে এবং মালিকদের শাস্তির আওতায় আনলে এসব সমস্যা থাকবে না।

‘শিল্পনগরকে পরিবেশসম্মত করতে হবে’

বিসিক ও শিল্পমালিকদের এই পাল্টাপাল্টি চলছে চার বছর ধরে। এর মধ্যে নদীদূষণ হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ (বেলা) সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মনে করেন, ট্যানারির বর্জ্যের সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক ধলেশ্বরী নদী থেকে অন্যান্য নদীতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১০০টি ট্যানারির জন্য বহু মানুষ জিম্মি হতে পারে না। তাই ট্যানারি প্রয়োজনে ছয় মাস বন্ধ রেখে সিইটিপি কার্যকর ও কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা নির্মাণ করে চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশসম্মত করতে হবে। তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে সরিয়ে তদারকির কাজটি দিতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা]