ডিজিটাল জগতে গোলটেবিল

কোভিড বা চলতি কথায় করোনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথমে মনে হয়েছিল, আর রক্ষা নেই। বিশেষভাবে বয়স্ক ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের সামনে ভয়াবহ ঝুঁকি। বিশ্বে এখন মোট আক্রান্ত ২৪ কোটি ৬৩ লাখ এবং মৃত্যুবরণ করেছেন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ (১ নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হিসাব)। যাঁরা সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আজও করোনা–পরবর্তী বিভিন্ন জটিল অসুস্থতায় ভুগছেন। বিশ্ব অর্থনীতিও সমস্যার মুখে পড়েছে।

এত দুঃসংবাদের মধ্যেও একটি সুসংবাদ হলো, ধীরে ধীরে আমরা অনেক অভিনব পদক্ষেপ নিয়ে করোনাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করেছি। একদিকে দ্রুত টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ, অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস।

তবে আধুনিক প্রযুক্তির উত্থান এই দুঃসময়ে ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। করোনার দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ডিজিটাল পদ্ধতিগুলো সহজে ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবন প্রমাণ করে, মানব সভ্যতা এখন ভয়াবহ কোনো হুমকি মোকাবিলার কার্যকর উপায় দ্রুত বের করতে সক্ষম।

এখন আমাদের সামনে একটা নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করার এই শুভক্ষণে আমরা ‘হাইব্রিড’ পদ্ধতিতে গোলটেবিল বৈঠক করছি।

একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘যত মুশকিল তত আসান’ অর্থাৎ সাংঘাতিক কোনো বিপদ যেমন ঝুঁকি সৃষ্টি করে, তেমনি নতুন সম্ভাবনার দরজাও খুলে দেয়। জুম মিটিং বা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে জরুরি কাজ করার চল আগেও ছিল; কিন্তু সেটা সর্বব্যাপী পদ্ধতি ছিল না। করোনার দুর্যোগ শুরুর পর, বছর দেড়েক আগে থেকে আমরা হাতে মুঠোফোন নিয়ে জুম মিটিং করে দেখলাম, অনেক কাজই করা সম্ভব। শুধু সাংবাদিকতা নয়, অনেক অফিসের কাজ, এমনকি বেশ কিছু স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাও জুম মিটিং করে ক্লাস নিচ্ছেন।

আমাদের পত্রিকার একটা বড় দায়িত্ব হলো, বিভিন্ন জরুরি ইস্যুতে বিশেষজ্ঞদের মতামত পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলোচনার ব্যবস্থা করা। সাধারণভাবে এটা ‘গোলটেবিল বৈঠক’ নামেই পরিচিত। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, যেসব ঘটনা সমাজকে আলোড়িত করে, গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে তার প্রকৃত কারণ ও সমাধানের উপায় মানুষের কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। যেমন ধরা যাক, নারী ও শিশু নির্যাতন হঠাৎ বেড়ে গেল। কী করা দরকার। সমাজের বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত কী? মানুষ জানতে চায়। তখন আমরা সাধারণত আমাদের পত্রিকা অফিসে নির্দিষ্ট আলোচনা কক্ষে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার আমন্ত্রণ জানাই। পরদিন তাঁদের আলোচনার মূল বিষয়গুলো পত্রিকায় ছাপাই। আমাদের অনলাইনে যায়। আমাদের প্রস্তাব ও পরামর্শগুলো শুধু পাঠকদের কাছেই না, সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছেও পৌঁছায়। এভাবে সমাজে জনমত গড়ে ওঠে।

এ সময় আমরা জুম মিটিংয়ের ব্যবস্থা করি। সামনাসামনি উপস্থিত না হয়েও দূর থেকে জুম বা অন্যান্য অ্যাপ ব্যবহার করে আমাদের আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করি। এই আলোচনার একটি বাড়তি সুবিধা হলো, সরাসরি সম্প্রচার, যাকে বলে লাইভ টেলিকাস্ট করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের আলোচনা প্রথম আলো ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করায় শুধু দেশের নয়, প্রবাসী বাঙালিরাও বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় কার্যত অংশ নিতে পারেন, মতামত জানাতে পারেন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। প্রতিটি আলোচনায় অন্তত কয়েক লাখ ব্যক্তি যুক্ত হতে পারেন।

শুধু তা–ই নয়, ডিজিটাল পদ্ধতির সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আরও একটি বিশেষ সুবিধা পেয়েছি। যেমন ধরা যাক, ‘করোনায় করণীয়’ বিষয়ে আমরা একটি ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করলাম। সেখানে দেশের বিশিষ্টজনেরা তো বটেই, একই সঙ্গে আমেরিকা–লন্ডন–অস্ট্রেলিয়া–প্যারিস থেকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ প্রবাসী বাঙালিকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালাম।

এখন আমাদের সামনে একটা নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করার এই শুভক্ষণে আমরা ‘হাইব্রিড’ পদ্ধতিতে গোলটেবিল বৈঠক করছি। এ ব্যবস্থায় দেশের বিশিষ্টজনেরা তো অবশ্যই সশরীর উপস্থিত থাকেন, একই সঙ্গে কেউ হয়তো প্রবীণ, সরাসরি উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় না, তিনিও জুমে যোগ দেন। একই সঙ্গে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একজন প্রবাসী বাঙালি হয়তো যুক্ত হয়ে তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত দেন।

এটা ঠিক যে করোনার ভয়াবহতা এখনো চলছে। আবার যে বাড়বে না, তা বলা যায় না। যাঁরা করোনামুক্ত হয়েছেন, তাঁদের অনেকের ফুসফুস–হার্ট–লিভার–কিডনির কার্যক্ষমতা হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু আমাদের পত্রিকাই নয়, অন্যান্য পত্রিকার সাংবাদিক, ডাক্তার–নার্স, শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অগণিত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমরা সবার স্মৃতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

জীবন থেমে থাকে না। আমরা কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসছি। কিন্তু করোনা–উত্তর যুগে আমরা দৈনন্দিন জীবনে আধুনিক বিজ্ঞান ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরছি।

  • আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক