ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে, ৫৭ ধারা থাকছে না

ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার করে পরিচালিত যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কার্যক্রম আইনের আওতায় আনতে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করতে যাচ্ছে। এই আইনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিষয়ে সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনের খসড়ায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে পৃথক শাস্তির ব্যবস্থা থাকছে।
নতুন ওই আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সমালোচিত ও বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ চারটি ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা বাক্স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের অন্তরায় বলে আইনজ্ঞরা মত দিয়ে আসছিলেন। আইনের ওই ধারাটি জামিনযোগ্য নয়, যার সর্বশেষ শিকার হন সাংবাদিক প্রবীর শিকদার।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নূর খানের বরাত দিয়ে ডয়চে ভেলে গত বছরের ২৫ আগস্ট জানায়, আসক-এর কাছে ১১ জনের তথ্য রয়েছে, যাঁরা এই আইনের অপব্যবহারের শিকার হয়ে কারাগারে আটক আছেন। তবে গতকাল রবিবার নূর খান জানান, এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য তাঁর কাছে নেই।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে নতুন আইন হওয়া প্রয়োজন। তবে বিতর্ক তৈরি হয় এমন কোনো কিছু বলা, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা চর্চার জন্য কারাদণ্ড হতে পারে না। তা ছাড়া বইয়ে লেখার জন্য একরকম এবং অনলাইনে লেখার জন্য আরেকরকম শাস্তি হতে পারে না বলেও মত দেন তাঁরা। তাঁরা আরও বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় আইনটি করা হচ্ছে, তাতে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
অবশ্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের পেনাল কোডে (দণ্ডবিধি) যেসব কাজ অপরাধ বলে গণ্য হয়, ডিজিটাল মাধ্যমেও সেসব ধরনের অপরাধ করা যায়। সাইবার ক্রাইম হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও মারাত্মক। সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করে তার শাস্তির ব্যবস্থা এ আইনে প্রস্তাব করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাইবার ক্রাইমই সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনের খসড়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছর রাখা হলেও অপরাধ বিবেচনায় সর্বনিম্ন সাজাও রাখা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন সাজা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
নতুন আইনে শাস্তির বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ তানজীব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে, মুখের কথার জন্য কাউকে শারীরিক শাস্তির শিকার হতে না হয়। তবে মুখের কথায় কারও মানহানি হলে, কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে বা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করলে মানহানির মামলা বা আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিধান থাকতে পারে।
নতুন আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অভিযোগ জামিনযোগ্য হবে কি-না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যখন খসড়াটি চূড়ান্ত হবে, তখন জানাতে পারব।’
৫৭ ধারা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪,৫৫ ও ৫৬ ধারা বাতিল করতে যাচ্ছে সরকার। এসব ধারা বাদ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ডিজিটাল সংক্রান্ত বিষয়গুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নাম পরিবর্তনসহ বেশ কিছু ধারায় সংশোধনী আনা হবে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয় মাস ছয়েক আগে। প্রথমে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০১৫ নাম দেওয়া হলেও সামগ্রিকতা বিবেচনায় এটি ডিজিটাল সিকিউরিটি ল-২০১৬ নামকরণ করা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গতকাল এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, অনলাইনে একটি অপরাধ হলে তার প্রভাব অনেক বেশি, প্রচারও বেশি। অফলাইনে সেটা কম। অনলাইনের অপরাধ রোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, এখন একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য অ্যাটম বোমা হামলার প্রয়োজন নেই। সাইবার আক্রমণ করে একটি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে এবং প্রশাসনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়।
৫৭ ধারা বাতিল হবে: ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। এর ৫৭ ধারাটির অপব্যবহার ও প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা এটাকে অসাংবিধানিক অভিহিত করে তা সংশোধনের দাবি তোলেন। সংবাদপত্রের প্রকাশক, মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ এবং বাংলাদেশ নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (নোয়াব) ওই ধারা বাতিলের দাবি জানায়। এসব দাবি ও প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে আইনমন্ত্রী গত আগস্টে বলেছিলেন, ‘সরকার বাক্স্বাধীনতার পক্ষে। যেহেতু ধারাটি নিয়ে কথা উঠেছে, সেহেতু এটি পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড। ইতিমধ্যে তিনজন আইনজীবী এই ধারাটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার একটি রিট নিয়ে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট ৫৭ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘বেশ দেরিতে হলেও ৫৭ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেটি করে যদি নতুন নামে কঠোর চেহারায় ফিরে আসে তাহলে তা নিন্দাযোগ্য।’ তাঁর মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার আগে এটি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, জনমত সৃষ্টিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ দরকার ছিল। তাঁর আশঙ্কা, ডিজিটাল নিরাপত্তা সুরক্ষার নামে বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।
আইনের সঙ্গে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বৈঠক: গতকাল রোববার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয়। আইনটির উদ্যোক্তা আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং এটা ছিল খসড়ার ওপর প্রথম বৈঠক।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩টি ধারা যাচাই-বাছাই করেছে মন্ত্রণালয়। কিছু বিষয় ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় যে খসড়া প্রস্তুত করেছে, তাতে ওই মন্ত্রণালয় সমর্থন দিয়েছে।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। খসড়া চূড়ান্ত করার আগে আরও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।