‘ডিজিটাল পাইরেসি’ নিয়ে উদ্বেগ

দেশে ডিজিটাল পাইরেসি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
প্রতীকী ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী প্রয়াত আবদুল আলীম। তিনি প্রায় পাঁচ শ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু গান তিনি নিজেই রচনা করেছেন। বাবার গান অন্যের নামে চালিয়ে দেওয়া দেখে বিস্মিত হন তাঁর মেয়ে নুরজাহান আলীম। বাবার সৃষ্টিকর্মের সুরক্ষায় তিনি সরকারের কপিরাইট অফিসে দ্বারস্থ হয়েছেন।

একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন প্রয়াত সংগীতশিল্পী বারী সিদ্দিকীর মেয়ে এলমা সিদ্দিকী। বাবার ১৯টি অ্যালবামের গান রক্ষায় তিনিও ছোটাছুটি করছেন কপিরাইট অফিসে।

প্রয়াত আবদুল আলীম ও বারী সিদ্দিকীর সব সৃষ্টকর্মের কপিরাইট নিবন্ধনের চেষ্টায় আছেন এই দুই শিল্পীর দুই মেয়ে। উদ্দেশ্য—যাতে অন্য কেউ এই দুই শিল্পীর সৃজনশীল কাজের (মেধাসম্পদ) মালিকানা দাবি করতে না পারেন। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস মেধাসম্পদের আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।

এলমা সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিবন্ধন না করলে বাবার গানগুলোর অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে একদিন। অন্য কেউ নিজের নামে তাঁর গান চালিয়ে দেবে। তাই নিবন্ধন করে নিচ্ছি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাবার সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি। আশা করছি, শিগগিরই কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে নুরজাহান আলীম বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে সঠিক তথ্য জানাতেই আমি আমার বাবার গান সংরক্ষণ করতে চাই।’

শিল্পী, বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে প্রতিনিয়ত কপিরাইট লঙ্ঘিত হচ্ছে। দিন দিন সৃষ্টিকর্ম চুরির প্রবণতা বাড়ছে। একজনের সৃষ্টিশীল কাজ অন্যজন নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ডিজিটাল পাইরেসি, যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সৃষ্টকর্মের কপিরাইট নিবন্ধন না থাকায় এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকছে না।

২০০৫ সালের কপিরাইট আইনে ডিজিটাল পাইরেসির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সংশোধিত আইনে ডিজিটাল পাইরেসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও সংশোধিত আইনটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২৬ এপ্রিল পালিত হচ্ছে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আইপি অ্যান্ড ইয়ুথ ইনোভেটিং ফর আ বেটার ফিউচার’।

কারও অনুমতি ছাড়া তাঁর সৃজনশীল কোনো কাজ ডিজিটাল উপায়ে নিজের নামে চালিয়ে অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনকে ‘ডিজিটাল পাইরেসি’ বলছে কপিরাইট অফিস।

জানতে চাইলে কপিরাইট রেজিস্ট্রার (যুগ্ম সচিব) নাফরিজা শ্যামা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কপিরাইট আইনটি সংশোধনের কাজ চলছে। এটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। আইনটি পাস হলে সৃষ্টিকর্ম চুরির প্রবণতা কমে আসবে। ডিজিটাল পাইরেসিও কমে আসবে।’

ব্যক্তির সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে যে মেধাসম্পদ তৈরি হয়, তার আইনগত সুরক্ষা দেওয়াই হচ্ছে কপিরাইট নিবন্ধন।

কপিরাইট অফিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সাহিত্যকর্ম, কম্পিউটার সফটওয়্যার, চলচ্চিত্রকর্মসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১ হাজার ২১৩টি কপিরাইট নিবন্ধন হয়। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৪৮টি। ২০২০ সালে কপিরাইট নিবন্ধন হয় ২ হাজার ৫৭৩টি। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ৩৪৪টিতে উন্নীত হয়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) কপিরাইট নিবন্ধনের সংখ্যা ছিল ৮৩৬টি।

কপিরাইট নিবন্ধন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে। তারপরে রয়েছে সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সংগীত ও সফটওয়্যার।

নিবন্ধন বাড়ার কারণ সম্পর্কে কপিরাইট অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। প্রতারণার শিকার হওয়ার পর অনেকের টনক নড়ছে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে কপিরাইট অফিস। সবকিছু ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। এসব কারণে কপিরাইট নিবন্ধন বাড়ছে।
নগর–পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব একটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় নির্মাণের জন্য নকশা তৈরি করে দেন। পরে তিনি জানতে পারেন, নকশাটি তাঁরই ঘনিষ্ঠ এক স্থপতি নিজের বলে প্রচার করছেন। নিজের সৃষ্টকর্ম অন্যজন দাবি করছেন দেখে ক্ষুব্ধ হন ইকবাল হাবিব। কিন্তু তাঁর নকশাটির বিপরীতে আইনগত স্বীকৃতি না থাকায় তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ লিমিটেডের’ নামে ১১টি স্থাপত্য নকশার কপিরাইট নিবন্ধন করেন ইকবাল হাবিব।

সক্ষমতার ঘাটতি

সৃজনশীলকর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি ডিজিটাল পাইরেসি প্রতিরোধে কপিরাইট অফিসের সক্ষমতার ঘাটতি লক্ষণীয়। কপিরাইট অফিসের জনবলকাঠামো ৪৯ জনের। এর মধ্যে এখন কর্মরত আছেন ৩৬ জন। যার মধ্যে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন মাত্র ৩ জন। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন ২ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আছেন ৩১ জন। এই জনবল দিয়ে পরিদর্শন, অভিযানসহ সব কাজ করছে কপিরাইট অফিস।

কপিরাইট অফিসের জন্য ৪৩৯ জনবলের একটি প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঝুলছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুমোদন মেলেনি।

কপিরাইট অফিস সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে এই অফিসের বর্তমান দপ্তর অবস্থিত। একতলাবিশিষ্ট অফিসটি বেশ পুরোনো।

স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দপ্তর, কিন্তু সেখানকার পরিবেশ দেখলে খারাপ লাগে। দেশে এখনো এমন সরকারি দপ্তর আছে, ভেবে অবাক লাগে।’

তবে আগারগাঁওয়ে ৬০ ফিট রাস্তার পাশে কপিরাইট অফিসের জন্য ১২ তলাবিশিষ্ট একটি ভবনের কাজ চলছে। কিন্তু এখনো ভবনের কাজ শেষ হয়নি।

থমকে আছে আইন সংশোধনের উদ্যোগ

কপিরাইট অফিসের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর প্রথম কপিরাইট আইন পাস করা হয় ১৯৭৪ সালে। পরে আইনটি বাতিল করে ২০০০ সালে নতুন আইন করা হয়। এটি ২০০৫ সালে সংশোধন করা হয়। যার বিধিমালা জারি হয় পরের বছর, ২০০৬ সালে।

তারপর অনেক নতুন নতুন বিষয় চলে আসে। কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা দেখা দেয়। এসব কারণে ২০১৫ সালের অক্টোবরে আইনটি সংস্কারের আলোচনা শুরু হয়। ২০১৮ সালে সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।

জানা গেছে, সংশোধিত আইনটি ঝুলে থাকার অন্যতম একটি কারণ প্রযোজকদের সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের বিরোধ।

গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীদের দাবি, ছবিতে ব্যবহৃত তাঁদের গান যদি ইউটিউবে দেওয়া হয়, সেখান থেকে তাঁদের ৫০ শতাংশ রয়্যালটি দিতে হবে।

প্রযোজকেরা বলছেন, পুরো সিনেমার মালিক প্রযোজক। তাই ছবি বানানোর পর গান ইউটিউবে ছাড়া হলে সেখান থেকে ৫০ শতাংশ রয়্যালটি তাঁরা দিতে রাজি নন।

সংশোধিত আইনে ডিজিটাল পাইরেসির প্রসঙ্গে আছে। এতে বলা হয়েছে, কারও সৃজনশীল কাজ অন্য কেউ চুরি করে ব্যবহার করলে যাচাই–বাছাই করে সংশ্লিষ্ট সাইট ব্লক করে দিতে পারবে কর্তৃপক্ষ। বিদ্যমান আইনে এই ধারাটি নেই। বিদ্যমান আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না কেউ।

সৃষ্টিকর্ম বেহাত

কপিরাইট নিবন্ধন না থাকায় নিজেদের কয়েকটি সৃষ্টিকর্ম বেহাত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ব্যাংক এশিয়ার সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল আলম। তিনি বলেন, ২০০২ সালে তাঁরা প্রথম ‘অ্যানিটাইম, অ্যানিহোয়্যার’ নামে একটি স্লোগান তৈরি করেন। পরে দেখেন, সেই স্লোগান অনেকেই ব্যবহার করছে। আবার ‘সিন্দাবাদ’ নামে তাঁরা একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেন। পরে দেখেন, সেটা অন্যরা ব্যবহার করছে। তাঁরা তখনো জানতেন না, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী। বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে পরে ব্যাংক এশিয়া তাদের সব লোগো ও স্লোগান নিজেদের নামে কপিরাইট নিবন্ধন করে।

তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা আগে থেকেই কপিরাইটের ব্যাপারে সচেতন। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং ও ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে চারটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে সানক্রপস নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই সফটওয়্যার এখন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চারটি সফটওয়্যার যাতে অন্য কেউ চুরি করতে না পারে, সে জন্য তার কপিরাইট নিবন্ধন করা হয়েছে।

জানতে চাইলে সানক্রপসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুরির ভয় থেকেই কপিরাইট নিবন্ধন নিয়েছি। যাতে অন্য কেউ তা নিজের বলে চালিয়ে দিতে না পারে।’

অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য সাইট নিয়েও প্রতারণা চলছে। বিএমএ বাজার ডটকমের নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মতো প্রায় একই ধরনের ওয়েবসাইট তৈরি করে অন্য একজন ব্যবসা করছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি কপিরাইট নিবন্ধন করেছি।’

কী কী বিষয় নিবন্ধন করা যায়

ধরুন, আপনি একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন। আপনি আশঙ্কা করছেন, এই সফটওয়্যারটি অন্য কেউ নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারে। চুরি থেকে সুরক্ষা পেতে আপনি এই সফটওয়্যার নিজের নামে কপিরাইট নিবন্ধন করতে পারবেন।

সফটওয়্যারের পাশাপাশি সাহিত্য, গবেষণাতত্ত্ব ও মোবাইল অ্যাপস কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। কম্পিউটার গেম, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, কার্টুন, বিজ্ঞাপন, অনুবাদকর্মও নিবন্ধন করা যায়। একই সঙ্গে স্থাপত্য নকশা, ফটোগ্রাফ, স্কেচ, ভাস্কর্য, ফেসবুক ফ্যান পেজ, গ্রাফিকস ডিজাইন ও বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মের কপিরাইট করার সুযোগ রয়েছে।

সাবেক কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কপিরাইট অফিসে জনবলের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এখানে জনবল বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে কপিরাইট আইনটিও দ্রুত সংশোধন করা উচিত।’