ডিসেম্বরের মধ্যে সব স্প্যান না বসলে সময়মতো চালু হবে না পদ্মা সেতু

নির্মানাধীন পদ্মা সেতুপ্রথম আলো

ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতুর সব স্প্যান (স্টিলের কাঠামো) বসানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এটা সম্ভব হলে আগামী বছরের ডিসেম্বরে সেতুটি চালু করা সম্ভব হবে। নতুবা পিছিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।

পদ্মা সেতুতে ৪১টি স্প্যান বসবে। দেড় শ মিটার লম্বা এসব স্প্যান জোড়া দিয়েই ৬.১৫ কিলোমিটার সেতু নির্মিত হবে। এখন পর্যন্ত ৩১টি স্প্যান বসেছে। অর্থাৎ সাড়ে চার কিলোমিটারের বেশি দৃশ্যমান। তবে সবটাই একটানা নয়। মাঝেমধ্যে কিছু পিলারে স্প্যান বসেনি। এখনো ১০টি স্প্যান বসানো বাকি আছে।

আগামী ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী, কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছিল। গত জুলাই মাসের মধ্যে সব স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি, পদ্মা নদীতে অত্যধিক স্রোত, নদীতে ভাঙন—সব মিলিয়ে কাজ পিছিয়ে গেছে। এ অবস্থায় নতুন করে কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত সূত্র জানায়, আগামী মাসের মাঝামাঝি একটি স্প্যান বসানো হবে। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর—এই তিন মাসের প্রতি মাসে তিনটি করে স্প্যান বসানো হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে সেতু চালুর সময়ও পিছিয়ে যাবে।

জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির প্রভাব আসলে গত ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়েছে। তবে তাঁদের কাজ এক দিনের জন্যও থেমে ছিল না। গতি কিছুটা কমেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার আশা করছেন। সময়মতো সেতু চালু করার বিষয়ে তাঁরা বদ্ধপরিকর।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, স্প্যান বসানোর মালামাল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে এখন কোনো সমস্যা নেই। বাকি ১০টি স্প্যানের ৭টিই প্রস্তুত আছে। বাকি তিনটি প্রস্তুতের কাজ চলছে। কিন্তু এখন মূল সমস্যা হচ্ছে বিদেশি পরামর্শক। দেশি-বিদেশি দক্ষ শ্রমিকেরও কিছুটা ঘাটতি আছে। উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর এই কাজে পরামর্শক, প্রকৌশলী ও শ্রমিক—তিনটির কোনো একটার ঘাটতি হলে কাজ বন্ধ কিংবা গতি কমে যায়। করোনা পরিস্থিতিতে পরামর্শক, প্রকৌশল ও শ্রমিক—তিনটিরই ঘাটতি হয়। এ জন্য প্রকল্পের কাজে কিছুটা গতি হারিয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২০০–এর মতো পরামর্শক কাজ করেন। তাঁরা ইংল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চায়না, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের অর্ধেকই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এর মধ্যে একেবারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ৮ থেকে ১০ জন ছাড়া কাজ চালানো কঠিনই।

পদ্মা সেতুর ফাইল ছবি

অন্যদিকে করোনার আগে প্রকৌশলী, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোকবল কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমিকের একটা বড় অংশই চীনা নাগরিক। তাঁরা গত ডিসেম্বরে চীনা নববর্ষের ছুটিতে দেশে গিয়ে আটকা পড়েন। পরে অবশ্য বেশির ভাগ ফিরে এসেছেন। দেশীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের প্রকল্প এলাকায় আইসোলেশন সেন্টারে রেখে কাজ যোগ দেওয়ানো হয়। এপরই নদীতে স্রোত ও ভাঙন শুরু হয়। সব মিলিয়ে গতি কমে যায়।

প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই ব্রিটিশ ও মালয়েশিয়াভিত্তিক দুজন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক আসবেন বলে জানিয়েছেন। দেশীয় শ্রমিকদের পাওয়া গেছে। বিদেশি কিছু দক্ষ শ্রমিক ও প্রকৌশলী এলেই পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, যেকোনো মূল্যে মূল সেতুর কাজ আগে শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নদীশাসনের কাজ বাকি থাকলেও সেতু চালু করে দিয়েও তা করা যাবে। এ জন্যই এখন মূল সেতুর কাজে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিদেশি পরামর্শকদের বেশির ভাগই বয়স্ক। তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। স্বাভাবিক সময়েই তাঁরা চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক কিংবা সিঙ্গাপুরে চলে যেতেন। করোনাকালে এই সুবিধা পাওয়া যাবে না ভেবে তাঁরা আসছেন না। এ ছাড়া বাংলাদেশে চিকিৎসা করালে ঠিকভাবে বিমা–সুবিধা পাওয়া যায় না বলে অনেক পরামর্শক জানিয়েছেন। এ জন্যই তাঁরা বাংলাদেশে আসতে চাইছেন না।

পদ্মা সেতুর কাজ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মূল সেতু ও নদীশাসন হচ্ছে বড় দুটি কাজ। এর বাইরে দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও টোলপ্লাজা নির্মাণ এবং অফিস, বাসাসহ নির্মাণ অবকাঠামোর কাজ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ ছাড়া বাকিগুলো শেষ হয়ে গেছে।

মূল সেতুর কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। আর নদীশাসনের কাজে নিয়োজিত আছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। গত জুলাই পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৮৯.২৫ শতাংশ। তবে নদীশাসনের কাজ এগিয়েছে ৭৪ শতাংশ।

প্রকল্পের অগ্রগতি–সংক্রান্ত বিষয় বিশ্লেষণ করে একজন কর্মকর্তা বলেন, স্প্যান উঠে যাওয়ার পর বাকি সব কাজ অনেকটা ‘ফিনিশিং’ পর্যায়ের। এসব কাজ মোট কাজের শতকরা হিসাবে খুব কম। কিন্তু সময় লাগে বেশি। এ জন্যই ফিনিশিং কাজের জন্য অন্তত এক বছর সময় হাতে রাখতে হবে।

পদ্মা সেতু দ্বিতলবিশিষ্ট। ওপরে চলাচল করবে যানবাহন। স্টিলের কাঠামো বা স্প্যানের ভেতর দিয়ে ট্রেন চলবে। ট্রেন চলাচলের জন্য লাইন বসানো হচ্ছে। আর যানবাহনের রাস্তার জন্য স্টিলের কাঠামোতে কংক্রিটের স্ল্যাব বসানো হচ্ছে। এরপর পিচঢালাই করা হবে।

পদ্মা সেতুর
ফাইল ছবি

নদীভাঙনের ক্ষতিও পোষাতে সময় লাগবে

মূল সেতুর কাজের ঠিকাদার এমবিইসির বড় নির্মাণ মাঠ রয়েছে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড) মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগে। গত ৩১ জুলাই বিকেলে সেখানে ভাঙন দেখা দেয়। প্রায় ৩.৩৪ হেক্টর এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে পড়ে।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সেখানে রাখা ১৯২টি রেলের গার্ডার (স্ট্রিনজার) ভেসে যায়। পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত এসব গার্ডার লুক্সেমবার্গ থেকে আনা। নদীতে ভেসে যাওয়ার পর নতুন করে গার্ডারের ফরমাশ দিয়েছে ঠিকাদার। এগুলো নির্মাণ করতে তিন মাস সময় লাগবে। বাংলাদেশে আসতে আরও এক মাস লাগবে।

এ ছাড়া ভাঙনের সঙ্গে যানবাহন চলাচলের পথ তৈরির কংক্রিটের ১২৫টি স্ল্যাব ভেসে গেছে। এগুলো প্রকল্প এলাকাতেই তৈরি হয়। তবে নতুন করে এসব স্ল্যাব তৈরি করতে মাসখানেক সময় লাগতে পারে। পদ্মা সেতুতে ২ হাজার ৯১৭টি স্ল্যাব বসানো হবে।

পদ্মা সেতুর
ফাইল ছবি

ব্যয় বাড়তে পারে

দুই দফা প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইতিমধ্যে বেশ কিছু খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। আরও নতুন ব্যয়ের খাত যুক্ত হয়েছে। তবে সবগুলো ব্যয় মিলিয়ে চালুর আগে আগে প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে সংশোধন করা হবে। তখনই আসলে ব্যয় কত টাকায় গিয়ে ঠেকে, তা জানা যাবে।

প্রকল্প সূত্র বলছে, বাজেটে ঠিকাদারের ভ্যাট ও আয়কর ৪ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ১০ শতাংশ। দেশীয় পরামর্শকদের ভ্যাট ও কর বেড়েছে ২ শতাংশ। এই তিন খাতে ভ্যাট ও কর বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৬৮৬ কোটি টাকা। এগুলো সামনে যোগ করা হবে।

এ ছাড়া সেতুতে ২২টি বাড়তি পাইল বসানো হয়েছে। এর খরচ আগে ধরা ছিল না। এর জন্য ব্যয় বাড়বে। গ্যাসলাইন এবং ৪০০ কেভি বিদ্যুতের লাইন বসানোর কাজেও ব্যয় বাড়তে পারে। এ ছাড়া করোনা শনাক্তের পরীক্ষা, কর্মীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা, চিকিৎসাব্যবস্থা চালুসহ নানা কারণে কিছু ব্যয় বাড়বে। সব মিলিয়ে আরও দেড় হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে সূত্র জানায়।

ব্যয়বৃদ্ধির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু কাজে ব্যয় কম হবে। কিছু কাজে ব্যয় বাড়বে। কাজের শেষ পর্যায়ে আসলে ব্যয় সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলা যাবে।