ডুবেছিল রংপুর, আশঙ্কা অন্য শহরেও

রংপুর শহরে জলাবদ্ধতাফাইল ছবি

রংপুর শহরে জলাবদ্ধতার ইতিহাস ছিল না। সেই শহর গত ২৬ অক্টোবর রাত থেকে ২৭ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত এক দিনের বৃষ্টিতে ডুবে গিয়েছিল। পানি নেমে যেতেও সময় লেগেছে কয়েক দিন। যদিও রংপুরে এক দিনে ৪৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত গত ৭০ বছরেও হয়নি। তারপরও সেই পানি নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে জলাবদ্ধতা হতো না। রংপুর শহরের পানিনিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থা নিয়ে মানুষ তাই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।

পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা বিবেচনায় রংপুর একটি আদর্শ নগর হওয়ার কথা। কারণ, রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় সাতটি পানির প্রবাহ। পানিনিষ্কাশনে এর প্রতিটি একেকটি আশীর্বাদ। এর মধ্যে পাঁচটি নদ–নদী হিসেবে পরিচিত। এগুলো হলো ঘাঘট, খোকসা ঘাঘট, ইছামতী, বুড়াইল ও আলাইকুমারী। অন্য দুটি প্রবাহ খাল হিসেবে পরিচিত—শ্যামাসুন্দরী ও কেডি খাল। তবে পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, শ্যামাসুন্দরী নদী হিসেবে প্রবাহিত হতো। ১৭৭৬ সালের রেনেলের ম্যাপে দেখা যায়, আজকের প্রবাহিত শ্যামাসুন্দরী আগেকার ঘাঘট নদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে জমিদার জানকী বল্লভ সেন নদীটি খনন করে তাঁর মা শ্যামাসুন্দরীর নামে নামকরণ করেন। তখন থেকে এটি খাল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

রংপুর নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সাতটি প্রবাহের একটির অবস্থাও ভালো নেই। এর মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। শ্যামাসুন্দরীতে সারা বছর পানি থাকত। বর্ষায় প্রচুর প্রবাহ ছিল। এটি বর্তমানে ঘাঘটের শাখা। ঘাঘট নদকে উৎসমুখ বন্ধ করে মেরে ফেলার কারণে শ্যামাসুন্দরীও প্রাণ হারাতে শুরু করে। ঘাঘট মূলত তিস্তার শাখা। ৪০-৪৫ বছর আগে তিস্তায় বাঁধ দেওয়ার সময় ঘাঘটের উৎসমুখ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ঘাঘটের প্রবাহ কমে আসে। সেই কারণে শ্যামাসুন্দরীতে পানির প্রবাহ কমে যায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। তলদেশ দ্রুতই ভরাট হচ্ছে। দুই পাড় দখল করেছে অনেকেই। ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। ঘাঘটের তলদেশ থেকে শ্যামাসুন্দরী এখন ২০-২৫ ফুট উঁচু।

উল্টো শ্যামাসুন্দরীর পানি এখন ঘাঘটে যায়। রংপুর নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে নীলফামারীর জলঢাকার শৈলমারী ইউনিয়নের আলসিয়াপাড়া গ্রামের যে স্থানে তিস্তা থেকে ঘাঘটকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, সেখানে তিস্তার সঙ্গে ঘাঘটের সংযোগ আবার স্থাপন করতে হবে। শ্যামাসুন্দরী ছাড়া বাকি ছয়টি পানির প্রবাহও সচল রাখতে হবে। এই প্রবাহগুলোর যথাযথ পরিচর্যা হলে শুধু পানিনিষ্কাশন নয়, এগুলো নগরকে নান্দনিকতাও দান করবে।

উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় জলাবদ্ধতার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। দিনাজপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনর্ভবা নদী। আর শহরের ভেতরে আছে দুটি খাল। ২০০ বছরের ইতিহাসে গত ২০১৭ সালে সবচেয়ে বড় বন্যা ও জলাবদ্ধতা হয়েছিল দিনাজপুরে। নদী ও খালগুলোর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা না থাকলে এ শহরের বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিত্য বছরের ঘটনায় পরিণত হবে।

রংপুর নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সাতটি প্রবাহের একটির অবস্থাও ভালো নেই। এর মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। শ্যামাসুন্দরীতে সারা বছর পানি থাকত। বর্ষায় প্রচুর প্রবাহ ছিল। এটি বর্তমানে ঘাঘটের শাখা। ঘাঘট নদকে উৎসমুখ বন্ধ করে মেরে ফেলার কারণে শ্যামাসুন্দরীও প্রাণ হারাতে শুরু করে।

নীলফামারী জেলা গড়ে উঠেছে বামনডাঙ্গা নদীর তীরে। নদীটি এখন খালের চেয়েও সরু। এ নদীর তীরে ছিল শাখামাছা বন্দর। সেই বন্দরের নামও বদলে গিয়ে হয়েছে বড়বাজার। নদীটি অনেক স্থানে সরকারিভাবে উল্লেখ করা হয়নি। অতি দ্রুত বামনডাঙ্গা নদীটিকে রেকর্ডভুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে নদীটির প্রবাহ ঠিক রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এখনো নীলফামারী জলাবদ্ধতার শিকার হয়নি। এ নদীকে মেরে ফেললে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় থাকবে না।

গাইবান্ধা জেলা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ঘাঘট। এ শহরের ভেতরেই নদটির কৃত্রিম পথ সৃষ্টি করা হয়েছে। শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নতুন-পুরোনো দুটি খাতই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পুরোনো খাতটিতে বর্তমানে ব্যাপক দখল চলছে। দূষণও আছে। শহরকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে এ দুটি খাত বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

ঠাকুরগাঁও শহর গড়ে উঠেছে টাঙ্গন নদের তীরে। এ নদের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে সেচ প্রকল্প চালানো হয়। শহরের পাশেই এ নদে মিলিত হয়েছে সেনুয়া ও চারাবান নদী। টাঙ্গন শুষ্ক মৌসুমে পানি পায় না। ফলে দ্রুতই এ নদ ভরাট হয়ে উঠবে। সারা বছর আগের মতোই পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে, নয়তো নদটি অভিশাপে পরিণত হবে। শহরের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা ঠিক রাখার পাশাপাশি এ নদেরও পরিচর্যা করার বিকল্প নেই।

রংপুর বিভাগের মধ্যে লালমনিরহাট শহর কোনো নদীর তীরে গড়ে ওঠেনি। এ শহর গড়ে উঠেছে রেলওয়ে ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। কুড়িগ্রাম গড়ে উঠেছে ধরলা নদীর তীরে। ধরলা নদীর ভাঙনে অনেকেই আজ দিশেহারা। উপযুক্ত পরিচর্যা না থাকলে আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে এ নদী। ধরলা একসময় মূল কুড়িগ্রামকে গ্রাস করেছে। এখন শহরের দিকে ভাঙন বন্ধ থাকলেও নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। পরিণতিতে ধ্বংসাত্মক আঘাত আসতে পারে শহরের ওপরই।

শুধু নদীর পরিচর্যা করলেই জলাবদ্ধতা দূর হবে, তা নয়। তবে শহরের নদী ও খালগুলো পানিনিষ্কাশনের সহজ পথ। জলাবদ্ধতা যাতে না হয়, সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আগাম, এখনই।

বগুড়ার মহাস্থানগড় গড়ে উঠেছিল করতোয়া নদীর তীরে। সমস্ত উত্তরাঞ্চলে এই নদী ছিল সবচেয়ে বড়। বগুড়া শহরও এ নদীর তীরবর্তী। বর্তমানে নদীটি শীর্ণকায়। নদীটিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড হত্যাই করেছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার খুলশী এলাকায় একটি ১০-১২ ফুট স্লুইসগেট দিয়ে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় নদীটি ভাটিতে ক্রমে সরু ও ভরাট হচ্ছে। ফলে দখলদারেরা দখলের উৎসবে নেমেছে। দখল-দূষণ বন্ধ করে স্লুইসগেট অপসারণ সাপেক্ষে বিধি মোতাবেক খনন করা জরুরি। নয়তো এ নদী বগুড়ার গলার কাঁটার মতো বিঁধতে থাকবে। মৃত্যুপথযাত্রী করতোয়াকে রক্ষা করা না গেলে জলাবদ্ধতা থেকে বগুড়া শহরকে নিরাপদ রাখা কঠিন হবে।

পাবনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ নদীকে নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নদীটি রক্ষা করা এবং সিএস নকশা অনুযায়ী প্রকৃত প্রস্থ নির্ধারণ জরুরি। শহরে পানিনিষ্কাশনেও এ নদী আশীর্বাদ। জয়পুরহাটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তুলসীগঙ্গা নদী। এ নদীর উজান ও ভাটি দুই অংশেই সর্বনাশ করা হচ্ছে। উজানে নদীটি খননের নামে সৌন্দর্য নষ্ট করে খালের মতো করা হয়েছে। ভাটিতে চিনিকলের বর্জ্য এসে পড়ে এ নদীতে। নওগাঁর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট যমুনা। নদীটি এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এ নদী যাতে দখলে-দূষণে মরে না যায়, তার কার্যকর ব্যবস্থা এখন থেকেই নিতে হবে। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন, সিরাজগঞ্জ জেলাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখতে ধানবান্দি নদী রক্ষা করতে হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা। রাজশাহী গড়ে উঠেছে পদ্মার তীরে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনকেও জলাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে নগরের মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য নদী-খালগুলোর পরিচর্যাসহ পানিনিষ্কাশনের অন্যান্য ব্যবস্থাও বহাল রাখতে হবে।

ঠাকুরগাঁও শহর গড়ে উঠেছে টাঙ্গন নদের তীরে। এ নদের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে সেচ প্রকল্প চালানো হয়। শহরের পাশেই এ নদে মিলিত হয়েছে সেনুয়া ও চারাবান নদী। টাঙ্গন শুষ্ক মৌসুমে পানি পায় না। ফলে দ্রুতই এ নদ ভরাট হয়ে উঠবে। সারা বছর আগের মতোই পানির প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে, নয়তো নদটি অভিশাপে পরিণত হবে।

রংপুর নগর যে কারণে জলাবদ্ধতায় ডুবে ছিল, লালমনিরহাট ছাড়া রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলার ১৫টিতেই অভিন্ন কারণে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে শহরের পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলে লালমনিরহাট শহরও দীর্ঘ মেয়াদে জলাবদ্ধতা শিকার হতে পারে। নগর প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এককভাবে কিংবা যৌথভাবে কোনো নদী-খাল রক্ষা করার কাজে নেই। প্রশাসনিকভাবে পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা উন্নত করা হয়নি। মানুষের অসচেতনতাও নেহাত কম নয়। যত পলিথিন ও ময়লা নর্দমায় ফেলা হয়। এতে পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

রংপুর নগরে তেমন শিল্পায়ন নেই। তারপরও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা অন্যান্য শহরে হবে না, এ কথা ভাবার কারণ নেই। শুধু নদীর পরিচর্যা করলেই জলাবদ্ধতা দূর হবে, তা নয়। তবে শহরের নদী ও খালগুলো পানিনিষ্কাশনের সহজ পথ। জলাবদ্ধতা যাতে না হয়, সে জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে আগাম, এখনই।


● তুহিন ওয়াদুদ, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক