ডেঙ্গু থামেনি, উদ্যোগে ভাটা

ডেঙ্গুর প্রকোপ শেষ হয়ে যায়নি। সরকারি হিসাব বলছে, গতকাল বৃহস্পতিবারও ১ হাজার ১০১ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আর প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গড়ে ২৫০ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, যা গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় তিন গুণের বেশি। অথচ এরই মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি কাজকর্মে গাছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

এ বছর ঢাকা শহরের বাইরে বিভিন্ন জেলায় ৪৪ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। নিশ্চিত মারা গেছে ৬৬ জন। প্রায় দেড় মাস ধরে ঢাকার বাইরেই বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ দেশব্যাপী ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ সরকারের নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ডেঙ্গু ও ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ে একাধিক দিন বক্তব্য দিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে একাধিক সভায় বলেছিলেন, ডেঙ্গু নিয়ে সারা বছর গবেষণা হবে, মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ হবে। এই কাজে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও বলেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করবেন। এখন দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার জন্য বাজেট বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে—এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গুর এত বড় প্রাদুর্ভাবের পর মশা মারার জন্য যে বড় ধরনের উদ্যোগ-আয়োজনের প্রয়োজন ছিল, তার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একই পরিস্থিতি এই দুই সিটি করপোরেশনের বাইরে সারা দেশেই।

মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জুলাইয়ের শুরুতে প্রথমে ঢাকায় ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আগস্টের মাঝামাঝি ঈদুল আজহার ছুটির সময় ঢাকা থেকে যাওয়া মানুষের সঙ্গে সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে—এই ধারণা কারও ছিল না। এ ব্যাপারে কোনো প্রস্তুতি সরকারের ছিল না।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মনে করেছিলাম, অক্টোবর নাগাদ ডেঙ্গু থাকবে না। কিন্তু ডেঙ্গু আছে। এখন মনে হচ্ছে, সারা বছরই কিছু না-কিছু ডেঙ্গু রোগী থাকবে।’

তবে মশা নিয়ন্ত্রণকাজে ভাটা পড়েনি বলে দাবি করেছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে কোনো শিথিলতা আসেনি। আগের মতোই কাজের গতি ধরে রেখেছি।’ তিনি বলেন, তাঁরা পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করেছেন। খুব শিগগির স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তা জমা দেবেন।

ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে এই মন্ত্রণালয় এখনো মাঠে নামেনি। মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। সারা বছর দেশব্যাপী মশকনিধন নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছে সরকার। কোন কোন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এই উদ্যোগে যুক্ত হবে, তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

>

অক্টোবরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
আশঙ্কা, দেশব্যাপী সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে
তবে মশা নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কাজের উদ্যোগ নেই

অবশ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাস্তবে এসব কাজ মাঠে গড়ানোর আগেই আগামী বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। তবে সেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কী আকার নেবে, তা কেউ অনুমান করতে পারছেন না।

একের পর এক ভুল-দুর্নীতি

২০১৭ সালে ঢাকায় চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণের একটি পরিকল্পনা দলিল তৈরি করেন।

‘মিডটার্ম প্ল্যান ফর কন্ট্রোলিং অ্যান্ড প্রিভেন্টিং এডিস-বর্ন ডেঙ্গু অ্যান্ড চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২২ পৃষ্ঠার ওই পরিকল্পনায় রোগ ও মশার ওপর নজরদারি, রোগী ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা, রোগের প্রকোপের সময় সাড়া দেওয়া, দক্ষতা বৃদ্ধি, আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগ এবং পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা ছিল। ২০১৯ সালের মধ্যেই তা বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ওই দলিলের চেহারাই অনেকে দেখেননি।

এমনকি ২০১৮ সালের প্রথম দিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার অকার্যকর ওষুধ ব্যবহার করছে—এই তথ্য জানার পরও নতুন ওষুধ ব্যবহার করতে এক বছরের বেশি সময় নেয় তারা।

গত দুই বছরে দেশের মানুষকে অনেক ভুল ও দুর্নীতির মাশুল দিতে হয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদেরা। জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা মশা নিয়ন্ত্রণে এখনো ভুল পথেই হাঁটছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মীরা মশা মারতে ফগিং মেশিন ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শকেরা বলেছেন, লার্ভা নিধনে জোর দিতে হবে। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

সব রেকর্ড ভেঙে গেল

২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় ঢাকা শহরে। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জন মারা যায়। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় ২০১৮ সালে। ওই বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এই সময়ে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে কিছু রোগীর সন্ধান পেয়েছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

এ বছর জুলাইয়ের শুরু থেকে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে। ওই মাসে ১৬ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়। আগস্টে হাসপাতালে রোগীর চাপ আরও বেড়ে যায়। ৭ আগস্ট প্রায় আড়াই হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। অন্যদিকে ঈদুল আজহার কাছাকাছি সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থেকে। একপর্যায়ে ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে।

গতকাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৯২ হাজারের বেশি। এত অল্প সময়ে আর কোনো রোগে এত বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে নেই। আইইডিসিআরের কাছে ২৪৬টি মৃত্যুর তথ্য আছে। এর মধ্যে ১৫৮টি ঘটনা পর্যালোচনা করেছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি। এর মধ্যে ৯৮টি মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কমিটি।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা আছে। দেশের সব পৌরসভা কর্তৃপক্ষ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদকে এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হতে হবে।’

ডেঙ্গু বড় আকারে শুরু হওয়ার পরপরই সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে নিয়মিত সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া শুরু হয়। প্রতিদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতেন রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা। সরকারের নানা উদ্যোগের কথাও দেশবাসী জানতে পারত সেই তথ্য থেকে। অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ আছে। চেষ্টা করেও গতকাল সানিয়া তহমিনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।