ঢাকা অভিযানের শেষ পর্ব

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নানা দেশের কবিরা বাঙালির পক্ষে কলম ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে বিদেশি গবেষকেরাও এ ঘটনার দিকে না তাকিয়ে পারেননি। প্রথমে ভারতের, পরে পশ্চিমা দেশগুলোর। মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্ব নিয়ে তাঁদের বিবেচনা।

েলফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের আগমুহূর্ত, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ছবি: সংগৃহীত

পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর অভিযান শুরুর ১৩ দিন পর আজ ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স নামে পরিচিত ঘাসে ছাওয়া ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ৭ মার্চ এই রেসকোর্স ময়দানেই সমবেত হাজার হাজার বাঙালির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান আহ্বান জানিয়েছিলেন, সামরিক আইনের অবসান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের, স্বায়ত্তশাসনকামী যে দলটি নির্বাচনে অর্জন করেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আজ আর কোনো ভাষণ ছিল না—ঘাসের ওপর পাতা একটি টেবিলের সামনে বসে‌ছিলেন কেবল দুজন মানুষ— লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এস অরোরা এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি, পূর্ব পাকিস্তানে ৭০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের কমান্ডার, যিনি স্বাক্ষর দিলেন, পাকিস্তানি আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক দলিলপত্রে।

ভারতীয় অভিযানের শেষ প্রহরগুলো, রেসকোর্সের আনুষ্ঠানিকতায় যার পরিণতি, কেটেছিল মেশিনগান ও ভারী কামানের পালানুক্রমিক অগ্নিউদ্‌গারণে যখন ঢাকার ঠিক বাইরে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে দুই দলের মধ্যে চলছিল লড়াই।

ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ঢাকা প্রবেশ করতে পেরেছেন মাত্র সাতজন পশ্চিমা সাংবাদিক এবং তাঁদের মধ্যে বর্তমান সংবাদদাতাও একজন।

পাকিস্তানিদের দিকে তাক করে ভারতীয় বাহিনী যখন গোলা নিক্ষেপ করছিল, তখন গ্রামবাসী দল বেঁধে চুপিসারে বসে তা দেখছিল। আজ সকালে ঢাকা থেকে ৯ মাইল দূরে বরপা গ্রামের ধানের খেতে এমনি দৃশ্যেরই অবতারণা ঘটেছিল। এখানে ছয়টি ৭৫ মিলিমিটার মাউন্টেনগানের ব্যাটারি নদীর অপর পাড়ে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ করছিল।

প্রায় ১০০ গজ দূরে বসে শতাধিক লোক এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গর্জমান কামানের গোলা নিক্ষেপ দেখছিল।

অগ্রবর্তী পরিদর্শকের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে কমান্ড পোস্টের একজন অফিসার চিৎকার করে উঠলেন, ‘চমৎকার শুটিং হয়েছে। কিছু গাড়ির ওপর আমরা আঘাত হানতে পেরেছি।’

যুদ্ধবিরতি, তবে

তখন সময় ছিল সকাল ১০টা। একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। তবে ভারতীয় অফিসাররা বলছেন, সেটা কেবল ঢাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং তাঁদের বাহিনী ঢাকা পর্যন্ত কামান দাগায়নি। ঢাকার কিছুটা আগের অবস্থান তাঁদের লক্ষ্য। তা ছাড়া উত্তর–পূর্ব দিক থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসরমাণ এই ব্রিগেডের কেউ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে কোনো কিছু জানে না।

বিপরীত দিকের পাকিস্তানি পক্ষও অন্ধকারে রয়েছে। কেননা এর অল্পকাল পরেই ঢাকার রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে যে অবস্থান, সেখানে শুরু হলো ট্যাংক, পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই।

এর আগের লড়াইয়ে ছিনিয়ে নেওয়া দুটি হালকা পাকিস্তানি ট্যাংককে ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন করল সুবিধাজনক অবস্থানে, একটি আমবাগিচায় এবং অপরটিকে বাঁধের ধারে ১০০ গজ বাঁ দিকে।

এবার আশপাশের সবার কানের পর্দা ফাটিয়ে গর্জন করে উঠল ট্যাংক। নদীর ওপারে দূরে যেখানটায় পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান নিয়ে ভারতীয়দের অগ্রগতি ব্যাহত করছিল, তার সংলগ্ন কারখানা এলাকা আরও চরমভাবে বিধ্বস্ত হলো এই গোলাবর্ষণে। ফ্যাক্টরি ভবন থেকে উঠতে লাগল কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া।

পদাতিক বাহিনীর অগ্রগতি

২০ মিনিট ধরে গোটা এলাকা গোলায় দুরমুজ করার পর শুরু হলো ট্যাংকের মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। ভবনের সামনে যেখানে বাংকার করে পাকিস্তানিরা ছিল, প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেল তা।

তখন বাঁধের নিচ দিয়ে ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর একটি কলাম এগোতে শুরু করল। তারা ডান দিকে মোড় নিয়ে একটি জলার ওপর দিয়ে ‌এগোতে লাগল নদীর দিকে।

দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ ঝলমলে রোদে পদাতিক বাহিনীর তৎপরতা দেখানোর জন্য সাংবাদিক দলটিকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় ইউনিট। পাকিস্তানিদের অবস্থান থেকে এখন আর পাল্টা গুলির কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বাঁধ বেয়ে ওপরের রাস্তায় উঠলাম এবং নীল আকাশের পটভূমিকায় নিজেদের শরীরের ছায়া পরিলেখ অঙ্কন করলাম। আস্থার সঙ্গে আমরা হাঁটছিলাম সামনের দিকে। মিনিটখানেক হবে।

হঠাৎ গর্জে উঠল একটি পাকিস্তানি মেশিনগান এবং পাশ দিয়ে হিসহিসিয়ে ছুটে গেল বুলেট। আমরা যে যেভাবে পারি, বাঁধের বিপরীত দিকে ঝাঁপ দিই এবং গড়গড়িয়ে পড়ার সময় উড়িয়ে দিই ধুলো ও কাঁকর। ভারতীয় মেজর আমাদের আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, গুলি আমাদের ১০-১৫ গজ দূর দিয়ে ছুটে গেছে।

পাকিস্তানিদের অব্যাহত গোলাগুলির ভেতর আমরা সাবধানে বাঁধের আড়াল ধরে এগোতে থাকি। কালভার্টের ওপর ছুটে বেড়ানো একটি বাচ্চা ছাগলের গায়ে এসে লাগে তাদের গুলি। একেবারে গুটিয়ে গেল ছাগশিশুটি। ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা একটি ভারতীয় প্লাটুনের কাছে পৌঁছাই। এরা বাঁধের ওপর শুয়ে পাকিস্তানিদের দিকে তাক করে রেখেছে রাইফেল ও মেশিনগান। পাকিস্তানিরা আমাদের পরিবর্তে এবার এদের উদ্দেশে গুলিবর্ষণ শুরু করল।

ভারতীয়রাও গুলিবর্ষণের জবাব দিতে লাগল। অবিরাম এই গোলাগুলির মধ্যে আমাদের সঙ্গে এক মেজর ফিল্ড রেডিওর বার্তা শুনতে পেলেন যে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। বিপরীত দিকের পাকিস্তানিদের নিঃসন্দেহে এ সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কতক পাকিস্তানি ইউনিটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ওড়ানো হলো বড় আকারের রুমাল

তখন সময় দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট। পাকিস্তানিরা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ভারতীয়দের নিজ অবস্থানে অনড় করে রেখেছে। তারপর প্রায় ১টা ৪৫ মিনিটে একজন পাকিস্তানি সৈনিক, সম্ভবত অফিসার, বিপরীত তীরের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে ওড়াতে লাগলেন বড় এক রুমাল।

ভারতীয় মেজর এস এস ধীলন বাঁধের ওপর উঠে নদীর তীরে নামলেন। একটি দেয়ালের আড়াল নিয়ে তিনি চিৎকার করে পাকিস্তানিদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করার জন্য বললেন।

‘তোমরা বের হচ্ছো কি হচ্ছো না, বলো’, চিৎকার করে উঠলেন মেজর। ‘আমি চাই তোমরা বের হয়ে এসো। এক মিনিট সময় দিলাম, এরপর আমার ধৈর্য থাকবে না। আমি চাই তোমরা বের হয়ে এসো। তোমার লোকদের জড়ো করো এবং সামনে এগিয়ে এসে নদী পার হওয়ার ব্যবস্থা নাও। তোমার ওই বেজন্মা স্টেনগান মাটিতে ফেলে দাও। কামানের গোলায় তোমাদের ছিন্নভিন্ন করে দিতে বাধ্য কোরো না আমাকে। আমি আবারও বলছি, বের হয়ে এসো, বের হয়ে এসো।’

মেজরের পিছু পিছু সাংবাদিকেরাও এগিয়ে এসেছিলেন দেয়ালের কাছে। কিন্তু তাঁরা যেখানটায় গুটিসুটি মেরে বসে ছিলেন, সেখান থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মেজর সদাশয়ের পরিচয় দিয়ে অবস্থা বর্ণনা করছিলেন, ‘ওখানে একজন অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আছে আরও চারজন লোক। সে সাদা রুমাল নাড়াচ্ছে। এবার ওরা আত্মসমর্পণ করছে। সব মিলিয়ে ১০ জন।’

বাদবাকি পাকিস্তানি, সংখ্যা তাদের যা–ই হোক, স্পষ্টতই পালিয়েছে। এই দৃশ্য—যা সম্ভবত পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের শেষ লড়াই সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল ২০ মিনিট। এই সময় পাশের এক অগভীর পদ্মপুকুরের ধারে বসে গোঙাচ্ছিল যন্ত্রণাকাতর আহত দুই ভারতীয় সৈনিক। মেজর যখন আত্মসমর্পণকারী প্লাটুনকে জড়ো করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় ধুলার ওড়াউড়ি দেখে ইঙ্গিত পাওয়া গেল ব্রিগেড হঠাৎ করে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।

প্রতিটি মুখে আনন্দের ছোঁয়া

দূরে পিস্তল-বন্দুকের গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেও গুরুতর প্রতিরোধের কার্যত অবসান ঘটেছে। ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর কলাম—প্রতিটি সৈনিকের চোখে–মুখে আনন্দের ছোঁয়া—এগিয়ে যাচ্ছিল প্রাদেশিক রাজধানীর দিকে। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যে ট্যাংকগুলো পাকিস্তানিদের দফারফা করছিল, তারই একটিতে সওয়ার হয়ে এগোলেন বর্তমান সংবাদদাতা।

রাস্তা ভরে আছে ঢাকাগামী সৈন্য ও বাঙালিতে, তাদের অবলম্বন ট্যাংক, ট্রাক, স্কুটার, সাইকেল, রিকশা এবং স্রেফ পদযুগল। যে যেভাবে পারছে সওয়ার হচ্ছে মুক্ত রাজধানীর উদ্দেশে। একটি সামরিক বহরের চেয়ে দৃশ্যটা বরং অনেকখানি সার্কাসের প্যারেডের মতো।

সৈন্যদের যাত্রাপথের সবখানেই বাচ্চাদের কোলে নিয়ে তুলে ধরছে পিতা, তাদের হাত ধরে নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে এসে জলচর ট্যাংকটির নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য যাত্রী কিছু ঝেড়ে ফেলতে হলো। আমি একটা দেশি নৌকা নিয়ে নদী পার হই। অপর পাড়ে এসে আরও কতক অফিসার, সৈনিক, সাংবাদিক মিলে সওয়ার হই জিপে, জিপের চালক ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আর এন মিশ্র।

যুদ্ধের কিছু ক্ষত

পুরু মোচের কমান্ডার ঢাকার পথে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে, সামনের বনেটের ওপর বসা যাত্রীদের গাদাগাদি ভিড়ের ফাঁক দিয়ে কোনোক্রমে রাস্তা দেখে নিতে চেষ্টা করছিলেন। আমরা যে গ্রাম এলাকার মধ্য দিয়ে চলছিলাম, সেখানে যুদ্ধের বিশেষ ধ্বংসচিহ্ন নেই। সবখানেই প্রায় একই দৃশ্য। রাস্তার মাঝেমধ্যে পড়ে আছে অগ্নিদগ্ধ যান, কামান অথবা মর্টারের গোলায় বিস্ফোরিত, আরও দেখা যায় বোমায় বিধ্বস্ত পাকিস্তানি বাংকার। আর যেসব জায়গায় পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে, দেখা যাবে কালশিটে অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ও কুঁড়েঘর।

পশ্চাদপসরণকালে যেসব সড়ক ও রেলসেতু পাকিস্তানিরা ধ্বংস করেছে, তা ছাড়া গোটা অঞ্চল মোটামুটিভাবে বড় রকম ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কোথাও কোথাও এমনকি দেখা যায় ধানখেতের পাশের নালায় মাছের উদ্দেশে ঝাঁপ দিচ্ছে মাছরাঙা পাখি। কাছের কলাবাগানে সবুজ নারকেলবীথির নিচে চরে বেড়াচ্ছে গরু। বস্তুত অনেক সময় এটা বোঝা কঠিন হয়ে ওঠে যে এই দেশকে স্পর্শ করেছে একটা যুদ্ধ—সে কথা জানান দিচ্ছে কেবল মৃতদের নীরবতা এবং নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিরা, আর কখনোই যারা ফিরে আসবে না।

তা সত্ত্বেও যুদ্ধের এক সুস্পষ্ট চিহ্ন বিদ্যমান—রাস্তার ধারে পাকিস্তানি সৈন্যরা, যারা অপেক্ষা করছে আত্মসমর্পণের। তাদের অস্ত্র গ্রহণ কিংবা আত্মসমপর্ণ এলাকায় একত্র করার মতো সময় পাওয়া যায়নি এবং অস্ত্রসহ তারা রয়েছে রাস্তার ধারে। ২৫ মার্চ ও তারপর স্বায়ত্তশাসনকামী বাঙালিদের আন্দোলন দমন করতে নিরস্ত্র সাধারণজনের বিরুদ্ধে এই অস্ত্রের ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন যেসব পথচারী, তাঁদের জন্য এ এক রক্ত হিম করা দৃশ্য।

পাকিস্তানিদের দেখাচ্ছে কেমন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন এবং তাদের মনোবল নেই বলে মনে হয়। তারা সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ালেও যে জনগণ তাদের বুলেটের রাজত্বে এত যন্ত্রণা ভোগ করেছে, সেখান থেকে তেমন কিছু পাওয়া সুদূরপরাহত।

কমান্ড পোস্টের ব্যারাকের সামনে ব্রিগেডিয়ার মিশ্র তাঁর জিপ থামালেন। পাকিস্তানি অফিসারকে নির্দেশ দিলেন আত্মসমর্পণ গ্রহণের জন্য ভারতীয় সৈন্যরা এসে পৌঁছানো অবধি তার লোকজনের ভেতরে রাখতে। সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘কেউ রাস্তায় যাবেন না। ওখানে মুক্তিবাহিনী থাকতে পারে।’

মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্যই প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব। তাঁদের রাজনৈতিক টার্গেট কেবল পাকিস্তানি সৈন্যরা নয়, সেনাবাহিনী প্রশিক্ষিত রাজাকার বা হোমগার্ড এবং অবাঙালি ও অন্য আরও বেসামরিক দালালরাও।

জিপে বসা এক অফিসার বললেন, ‘এই ডামাডোলের মধ্যে আমরা যদি পাকিস্তানিদের রক্ষা না করি, তবে মুক্তিবাহিনী তাদের কচুকাটা করবে।’

অস্বস্তিকর সংঘাত

জিপ যখন ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছিল, হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো কয়েক শ বাঙালি, আনন্দে উদ্বেল তারা সবাই, উচ্চ কণ্ঠে স্বাগতিক স্লোগান দিয়ে এগিয়ে আসছিল ভারতীয় বাহিনীর দিকে।

এদিকে ৫০ ক্যালিবর মেশিনগান বসানো একটি পাকিস্তানি জিপও এগোচ্ছিল জটলার দিকে। পাকিস্তানিরা মনে করল, জনতা বুঝি তাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং মেশিনগানের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করল কয়েক দফা। দুই ব্যক্তি পড়ে গেল মাটিতে, আহতদের ধরাধরি করে তুলে জনতা আবার মিলিয়ে গেল।

ক্রুদ্ধ ব্রিগেডিয়ার মিশ্র ও ভারতীয় বাহিনী চার পাকিস্তানিকে পাকড়াও করে তাদের অস্ত্রপাতি কেড়ে নিল। সমানে গালাগাল করে চলল তাদের, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভয়ে একেবারে মিইয়ে গেল, ভেবেছিল এখনই বুঝি তাদের প্রাণে মারা হবে। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলো অন্যত্র প্রহরাধীনে রেখে কোর্ট মার্শাল করার জন্য।

পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের পরিবার–পরিজন নিয়ে বোঝাই একটি বাস দেখা গেল ঢাকার দিকে যাচ্ছে। বাসের ছাদেও লোকজন। নারী ও শিশুরা যেভাবে পুরুষসঙ্গীর লগ্ন হয়ে আছে, স্মরণ করিয়ে দেয় তা ভীত শরণার্থীদের চিত্র।

ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা আক্রমণ শুরুর আগেই যেহেতু পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে, তাই শহরের কোনো বড় রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বিমানবন্দর ও মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে বোমাবর্ষণের ক্ষতি ছাড়া তেমন আর বিশেষ কিছু ঘটেনি।

বিমানবন্দর অভিমুখী রাস্তায় এখনো বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। রানওয়ে মেরামত করা হয়েছে। তবে একদিকে স্তূপ করা আছে একদা যা ছিল জঙ্গি বিমান, তার ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপ। টার্মিনাল ভবনের জানালার সব কাচ বিমান হামলায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।

বহু বাড়িঘর, দোকানপাট এখনো তালাবদ্ধ, অপেক্ষা করছে গৃহকর্তা ও মালিকের প্রত্যাবর্তনের। এরপরও নীরবে জমে উঠছে ভিড়। যেন শূন্য থেকে উদয় হচ্ছে এদের। তারা ঘিরে ধরছিল আমাদের গাড়ি—আনন্দধ্বনি করে ভাই বলে ডাকছিল আমাদের এবং হাতে হাত মেলাচ্ছিল। স্পর্শ করতে চাইছিল আরেকজন মানুষকে।

সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে ভারতীয় ১০টি হেলিকপ্টারের বহর একসঙ্গে উড়ে এসে বিমানক্ষেত্রে অবতরণ করে। জেনারেল অরোরা ও অপরাপর ভারতীয় অফিসারদের তারা বহন করে নিয়ে এসেছে কলকাতা থেকে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য এঁরা সবাই এসেছেন। টারমাকে অপেক্ষা করছিলেন জেনারেল নিয়াজি, কসরত করে আত্মসম্মানের মুখোশ এঁটে রাখছিলেন, মাথায় তাঁর কালো টুপি, হাতে একটি ভাঁজ করা বহনযোগ্য শিকারির আসন, যদিও এর ভাঁজ খুলে বসেননি তিনি কখনো। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে জেনারেল অরোরার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, অল্প কিছুক্ষণ আগেও আনন্দে উন্মত্ত বাঙালি জনতার অধীর আলিঙ্গনে অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি।

উভয়েই স্বাগত জানাতে এগিয়ে গেলেন জেনারেল অরোরার হেলিকপ্টারের দিকে। মাইক ও কামেরাবেষ্টিত থাকার পর তাঁরা আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের জন্য গাড়ি করে রেসকোর্স ময়দানের দিকে চললেন।

দলিল স্বাক্ষরের পর দুই জেনারেল উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন। একটি জিপে করে ফিরে চললেন জেনারেল নিয়াজি, স্টাফ কারে জেনারেল অরোরা।

ভারতীয় সামরিক দলটি যখন ফিরে যাচ্ছিল, বিমানবন্দরে তখনো বিক্ষিপ্ত গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে তাঁরা কলকাতার উদ্দেশে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন। দিনজুড়েই শহরে চলছিল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। রেডক্রস ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে ঘটে বন্দুক লড়াই।

রাতে আত্মসমপূর্ণস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে দীর্ঘ সারিতে দাঁড় করানো পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখাচ্ছিল আগ্রহী ও আশ্বস্ত। কেননা, সেখানে বাঙালিদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবে ভারতীয় বাহিনী।

সূত্র: ডেডলাইন ১৯৭১, শিডনি শনবার্গ, অনুবাদ: মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ,

সিডনি শনবার্গ ১৯৭১ সালে ভারতের দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো পর্বজুড়ে তিনি সংবেদনশীলতার সঙ্গে প্রতিবেদন রচনা করে গেছেন।