ঢাকা ও গাজীপুরে সাধারণ মানুষসহ বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে ঢাকা ও গাজীপুরের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

ঢাকা

১৯৭১ সালে বিউটি বোর্ডিংয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি করে ১৭ জনকে হত্যা করে। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালে বিউটি বোর্ডিংয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুলি করে ১৭ জনকে হত্যা করে। ছবি: সংগৃহীত

রাজারবাগ পুলিশ লাইন বধ্যভূমি
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম নির্যাতনকেন্দ্র ও একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানকার পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে প্রায় দুই হাজার বাঙালি পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। যুদ্ধের সময় এ কেন্দ্রে অনেককেই নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। পাকিস্তান বাহিনী এখানে নারীদের ওপরেও অকথ্য নির্যাতন চালায়।

রোকেয়া হল গণকবর

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আক্রমণ চালায়। এখানে অবস্থানরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৬ জনকে হত্যা করা হয়। পরে তারা এই লাশগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলে। তারপর সেই গণকবরের ওপরে ট্যাঙ্ক চালিয়ে চলে যায়। স্বাধীনতার পর রোকেয়া হলের এই গণকবর খনন করে প্রায় ১৫টি মাথার খুলি ও হাড়গোড় উদ্ধার শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদসংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

জগন্নাথ হল বধ্যভূমি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল একটি বধ্যভূমির নাম। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ এই হলের নিরস্ত্র-নিরপরাধ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর নৃশংস নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা হলের তিনজন শিক্ষক, ৩৪ জন ছাত্র ও চার কর্মচারীকে গুলি করে হত্যা করে। হলের মাঠে বিরাট গর্ত করে লাশগুলো পুঁতে ফেলা হয়। পরে বুলডোজারের সাহায্যে তাঁদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে থেকেই মিরপুরের রায়েরবাজার এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অন্যতম বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। এখানকার প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল এই বধ্যভূমি। যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আলবদর ও রাজাকারেরা এখানে বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজারের এই বধ্যভূমিটির খোঁজ পায় মানুষ। ওই দিন রায়েরবাজারের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য লাশ উদ্ধার করা হয়। এই বধ্যভূমিতেই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল।

আদাবর গণকবর
ঢাকার মোহাম্মদপুর জয়েন্ট কলোনি ও কল্যাণপুর বাস ডিপোর মাঝামাঝি আদাবরে স্বাধীনতার পর কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গণকবর থেকে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া এখানকার একটি মসজিদের পাশে পাওয়া গেছে বৃহৎ গণকবর। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মুক্তিগামী মানুষদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

মোহাম্মদপুর উত্তর সীমান্ত বধ্যভূমি
স্বাধীনতার পর মোহাম্মদপুরের পাঁচটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে শত শত মানুষের হাড়, কঙ্কাল পাওয়া। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদররা নারী-পুরুষ-শিশুনির্বিশেষে নিরীহ বাঙালিদের হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দেয়। প্রাপ্ত কঙ্কালের খুলিতে লম্বা চুল ও চুড়ি দেখে বোঝা যায় এগুলো নারীদের দেহাবশেষ।

বসিলা ইটখোলা বধ্যভূমি
ঢাকার মিরপুরের বসিলার ইটখোলা বধ্যভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে ধরে নিয়ে এসে মুক্তিগামী মানুষকে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর এখানে বহু মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়।

শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি
যুদ্ধকালে শিয়ালবাড়ি এলাকাটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বধ্যভূমি ও গণকবর হিসেবে ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে তারা এখানে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। স্বাধীনতার পর শিয়ালবাড়ির ঝোপে, জঙ্গলে, গর্তে, কুয়ায় পাওয়া গেছে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি ও হাড়। আনুমানিক ৩০–৪০ হাত গভীর দুটি কুয়ার প্রতিটিতে পাওয়া যায় প্রায় এক শ নরকঙ্কাল।

মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ধরে মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের পেছনে এনে হত্যা করত।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’। এখানে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর এবং বিহারিরা বাঙালি নিধনযজ্ঞের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। মিরপুর খালের ধারের এ নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাঙ্কের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস। জায়গাটি নির্জন তাই ঘাতকেরা একে বধ্যভূমি হিসেবে বেছে নেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানে মুক্তিগামী মানুষদের নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই এ বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। সে সময় আশপাশে অসংখ্য বাঙালির কঙ্কাল পড়ে ছিল। এ পাম্পহাউসের ভেতরে একটি উঁচু বেদিতে উর্দুতে লেখা ছিল ‘জল্লাদখানা’। এখানে অনেক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়। ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে পুনরায় খননকাজ শুরু করে। খননের পর এ বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি ও ছোট–বড় ৫ হাজার ৩৯২টি হাড়গোড় পাওয়া যায়।

হরিরামপুর গোরস্থান বধ্যভূমি
মিরপুরের হরিরামপুরের বধ্যভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক ও একজন চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে যে চারজন বুদ্ধিজীবীর লাশ শনাক্ত করা হয়, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সন্তোষ ভট্টাচার্য, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিরাজুল হক খান ও আ ন ম ফয়জুল মহী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক মোহাম্মদ মোর্তজা। অপর এক গর্তে আরও তিনজনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম এ খায়ের, ইংরেজি বিভাগের রাশীদুল হাসান এবং বাংলা বিভাগের মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদদের স্বজনেরা এসব লাশ শনাক্ত করেন। গর্ত খুঁড়ে যখন তাঁদের লাশ তোলা হয়, তখনো তাঁদের প্রত্যেকের চোখ বাঁধা ছিল।
মুসলিম বাজার বধ্যভূমি
১৯৯৯ সালের ২৭ জুলাই মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকে নূরী মসজিদের পাশে মুসলিম বাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। মসজিদের নির্মাণকাজে মাটি খননের সময় এখানে একটি কুয়া থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ বধ্যভূমির খননকাজ শুরু করে। বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য হাড়, চুলের বেণি, মেয়েদের স্যান্ডেল, গলার চেইন, কাপড়, তাজা গুলি, মাইন প্রভৃতি উদ্ধার করা হয়। এখানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে হত্যার পর পুঁতে রাখা হয়েছিল।

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকার রমনা কালীবাড়িতে ৫০ থেকে ৬০ জন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া ২৯ মার্চ বাঙালি ইপিআর অফিসার ক্যাপ্টেন আজাদসহ ২০ জন ইপিআর সদস্যকেও এখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এই জায়গাকে তারা বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

জগন্নাথ কলেজ গণকবর (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো সময়ে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। এখানে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে অসংখ্য নিরপরাধ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংসদ কার্যালয়ের সামনে এই গণকবর খনন করে সাতটি কঙ্কালসহ ছেঁড়া কাপড়, জুতো ইত্যাদি উদ্ধার করে।

এমএনএ হোস্টেল বধ্যভূমি
ঢাকা শহরের এমএনএ হোস্টেল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি। এখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গাজীপুর অস্ত্র কারখানা থেকে কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে ধরে এনে হত্যা করে।

ধলপুর ডিপো গণকবর
ঢাকার ধলপুর ডিপো এলাকায় বিশাল গণকবরের অসংখ্য মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা শহরের নানা জায়গা থেকে আনা লাশগুলো ধলপুর ডিপো এলাকার গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ঠাটারীবাজার বধ্যভূমি
ঠাটারীবাজার মৎস্যপট্টির পেছনের বধ্যভূমিতে নবাবপুর বিসিসি রোডের রাজাকার ক্যাম্প থেকে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেপ্তারকৃত দুজন রাজাকারের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। রাজাকাররা জানায়, যুদ্ধের সময় তারা এখানে অসংখ্য বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করেছে।

তেজগাঁওয়ে বধ্যভূমি
তেজগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ২৭, ২৩ ও ৩৭ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টার প্রাঙ্গণের মাটি খুঁড়ে হাত-চোখ বাঁধা বেশ কয়েকজনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশগুলো শনাক্ত করা না গেলেও পুলিশের অনুমান, সম্ভবত তাঁরা ছিলেন বুদ্ধিজীবী এবং ১০-১৬ ডিসেম্বরে তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

সূত্রাপুর লোহারপুল বধ্যভূমি
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা বহু মানুষকে সূত্রাপুর লোহারপুলের ওপর এনে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই পুলের ওপর দাঁড় করিয়েই তারা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. হরিনাথ দেকে গুলি করে হত্যা করে।

ধামরাই বধ্যভূমি
ধামরাই থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরে কালামপুর বাজারে পাশেই আতাউর রহমান উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠসংলগ্ন একটি খাল রয়েছে। এই খালের ওপর যে কালভার্ট, সেখানে দাঁড় করিয়ে প্রায় ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের সময় এ স্থানটিকে পাকিস্তান সেনারা বধ্যভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

জিঞ্জিরা বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি বাহিনী কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা গ্রামে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুহূর্তের আক্রমণে জিঞ্জিরা গ্রাম পরিণত হয় এক বধ্যভূমিতে। পঁচিশে মার্চের কালরাতের পর ভীতসন্ত্রস্ত ঢাকাবাসী নগর ছেড়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল এই গ্রামে। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ২ এপ্রিল পাকিস্তান সেনারা এই গ্রামে হামলা চালালে প্রাণ দিতে হয় অসংখ্য মানুষকে। তারা পুরো গ্রামে লুট, ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই হত্যাকাণ্ডের পর গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল শত শত লাশ।

কুর্মিটোলা সেনানিবাস গণকবর
ঢাকা কুর্মিটোলা সেনানিবাস ও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকার পাশে রয়েছে গণকবর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন ট্রাকে করে লাশ এখানে আনত। গর্ত করে এসব লাশ মাটিচাপা দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিতেন সেনাসদস্যরা। এভাবে দিনের পর দিন এখানে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।

মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউট বধ্যভূমি
ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউট ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্র। তাদের এই হেডকোয়ার্টারে অসংখ্য মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। জানা যায়, এই কেন্দ্রের বন্দীদের হত্যা করে তাদের চোখ তুলে রাখা হতো।

পাগার বধ্যভূমি
শিল্পনগর টঙ্গীতে প্রথম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর আক্রমণ চালায় এবং যুদ্ধকালে এখানে অনেক লোককে তারা হত্যা করে। তারা টঙ্গীর পাগার এলাকায়ও বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে।

বিউটি বোর্ডিং গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে গণহত্যা চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি করে ১৭ জনকে হত্যা করে। বিউটি বোর্ডিংয়ের অন্যতম মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ সেখানে অবস্থারত ব্যবসায়ী, শিক্ষক, প্রকাশক, অভিনেতা, এলাকাবাসী মিলে ১৭ জনকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন চন্দ্র সাহা, শামস ইরানী (চলচ্চিত্রশিল্পী), সন্তোষ কুমার দাস (ব্যবসায়ী), প্রেমলাল সাহা (ব্যবসায়ী), ক্ষিতীশ চন্দ্র দে (বোর্ডিংকর্মীর ভাই), নূর মোহাম্মদ মোল্লা (প্রতিবেশী), যোশেফ কোরায়া (অভিনেতা), শীতল কুমার দাস (ম্যানেজার), অখিল চক্রবর্তী (পাচক), সাধন চন্দ্র রায় (কর্মী), সুখরঞ্জন দে (কর্মী), কেশব দত্ত আগারওয়াল (ব্যবসায়ী), নির্মল রায় ও খোকা বাবু (সমাজসেবক), হারাধন বর্মণ (চিত্রশিল্পী), হেমন্ত কুমার সাহা (প্রকাশক), অহীন্দ্র চৌধুরী শংকরকে (ক্রীড়াব্যক্তিত্ব) ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তান সেনারা।

গাজীপুর
টঙ্গী টেলিফোন শিল্প সংস্থা গণকবর
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে টঙ্গীর টেলিফোন শিল্প সংস্থায় স্থাপিত হয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ঢাকা সদর উত্তর জোন হেডকোয়ার্টার। এখানে একটি টিনের ঘরে ছিল হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। যুদ্ধকালে এখানে অসংখ্য লোককে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এই এলাকার আশপাশে রয়েছে গণকবর।

টঙ্গীর মরকুন গণহত্যা
টঙ্গীর মরকুন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নৃশংস চিহ্ন রয়েছে। যুদ্ধকালে তারা এখানে অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছিল।

জয়দেবপুর রাজবাড়ি বধ্যভূমি
জয়দেবপুরের পাকিস্তান সেনাদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারা রাজবাড়িকে অন্যতম নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্রে পরিণত করে। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন ও নির্মমভাবে হত্যা করে রাজবাড়ির আশপাশে পুঁতে রাখত। স্বাধীনতার পর রাজবাড়ি এলাকা থেকে বহু মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, আবু সাঈদ সম্পাদিত; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ডা. এম এ হাসান, স্বাধীনতার দলিলপত্র, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, মুক্তিযুদ্ধ কোষ, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, দৈনিক বাংলা, ২০ জানুয়ারি ও ৩ এপ্রিল ১৯৭২ দৈনিক বাংলা, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, দৈনিক সংবাদ, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩, ২০-২১, দৈনিক সংবাদ, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩, গণহত্যা ও বধ্যভূমি ৭১, সাঈদ বাহাদুর, পৃ.- ১১, জিঞ্জিরা জেনোসাইড, নির্মলেন্দু গুণ

* এই দুই এলাকার গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]