ঢাকা কলেজ ফলকনামা
সুদীর্ঘ সময় ধরে টোল ও মক্তব-মাদ্রাসাগুলো ছিল এ দেশে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র। আর পাঠাশালাগুলো ছিল প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র। বাংলার প্রথম সরকারি ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয় ঢাকাতে। সময়টা ছিল ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই। নাম রাখা হয়, ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল’। পরবর্তী সময়ে এখানেই কলেজ শাখার উদ্বোধন করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা কলেজ’। এটা ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বরের ঘটনা। ঢাকার তৎকালীন জয়েন্ট কালেক্টর আর্থার লয়েড ক্লের প্রতিবেদনে যা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। প্রকাশিত হয় ১৮৬৮ সালে। ‘প্রিন্সিপ্যাল হেডস অব দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস অব দ্য ঢাকা ডিভিশন’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রতিষ্ঠাকালীন পুরো ক্ষণকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গের ওপর গবেষণার জন্য এটি একটি অতিমূল্যবান প্রতিবেদন।
ক্লে লিখেছেন, ‘অনেক আগে থেকেই কলেজ চত্বর এবং এর আশপাশের এলাকা ‘ঢাকা ফ্যাক্টরি’ হিসেবে ইংরেজ কোম্পানির দখলে ছিল। গুদামগুলো সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল এবং ১৮৩৬ সালে ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী এই সম্পত্তি মাসিক ১৭ টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন। ঢাকার স্থানীয় গণশিক্ষা কমিটি সরকারি স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করার চিন্তাভাবনা করে। কলেজ ভবন নির্মাণকল্পে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদাও সংগ্রহ করা হয়। ১৮৪১ সালে মি. শেফার্ডের কাছ থেকে ২ হাজার টাকায় নতুন ভবনের জমি কেনা হয় এবং কালেক্টরেট অফিসে এ–সংক্রান্ত স্বত্বপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশপসহ স্থানীয় কমিটির সদস্যরা বিদ্যালয় পরিদর্শনের পর অনুষ্ঠানস্থলের দিকে অগ্রসর হন। এখানেই স্টেশনের মূল বাসিন্দা এবং ৪৫তম এনআই বাহিনী মিলিত হয়। বিশপের উপযোগী এক বক্তৃতা শেষে মি. প্র্যাট (তৎকালীন প্রধান শিক্ষক) তাম্রফলকে মুদ্রিত লিপি পাঠ করেন, যা ভিত্তিপ্রস্তরে স্থাপন করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। লিপিতে মুদ্রিত ছিল-
অতঃপর মি. প্র্যাট একটি লেখ্যপট পাঠ করেন যাতে লেখা ছিল—
‘ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানে বাংলার এই অংশের যুবকদের শিক্ষার জন্য ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই ভারত সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি, যা ঢাকা কলেজ নামকরণ নিয়ে একটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে ৮০৯ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং যাদের আটটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে আটজন শিক্ষক দ্বারা ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়।’
অতঃপর ক্লাসের ক্রম, পাঠ্যবিষয়সমূহ, শিক্ষকদের নাম এবং স্থানীয় কমিটির সদস্যদের তালিকা। এরপর এই রেকর্ডটি সিসার বাক্সে আবদ্ধ একটি বোতলে ভরা হয় এবং বিশপ এটি ভবনের ভিত্তিমূলে উত্তর-পূর্ব কোণে সংস্থাপিত একটি বৃহৎ পাথরের মাঝখানে কাটা একটি ছোট প্রকোষ্ঠে রাখেন। সঙ্গে ছিল একটি তাম্রাগার, পুরোনো ও বর্তমান শাসনামলের কিছু ব্রিটিশ ও ভারতীয় মুদ্রা এবং কলকাতা সরকারের ১৮৪১ সালের একটি গেজেট। এগুলো পাথরের স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে তার ওপর চুন ও মর্টার দিয়ে শক্তিশালী করে এবং একই সঙ্গে ব্যান্ড দলের জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয়।
কলেজ ভবনটি গণপূর্ত বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। মূল নকশা তৈরি করেছিলেন কর্নেল গার্সটিন। আনুমানিক ব্যয় হয় সাড়ে ২৪ হাজার টাকা। ১৮৪৪ সালের শুরুর দিকে ভবন নির্মাণ যখন প্রায় সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে, তখন অনেক কক্ষ শুধু ক্লাসরুমের ভেতর দিয়ে প্রবেশযোগ্য হওয়ার কারণে ভবনের নকশার বিরুদ্ধে ভীষণ আপত্তি উত্থাপিত হয়। সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য নতুন করে একটি নকশা জমা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয়। সিঁড়ি স্থাপন করা হয় এবং যার মাধ্যমে বর্তমান বারান্দাগুলো তৈরি হয়। উত্তর পাশের বারান্দায় স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রায় অকেজো তিনটি শ্রেণিকক্ষকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হয়। ১৮৪৬ সালের শুরুর দিকে ভবনটির কাজ সমাপ্ত হয়। ওই বছরের জুলাইয়ে কলেজের ক্লাসগুলো সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
‘জেনারেল রিপোর্ট অন পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ শীর্ষক ১৮৪২-৪৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্কুল ও কলেজ সমন্বয়ে ঢাকা কলেজের সর্বমোট বার্ষিক ব্যয় ছিল ১৪১৫ রুপি। জে আয়ারল্যান্ড ছিলেন ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ। ১৮৪২ সালের ১ এপ্রিল তিনি এ পদে যোগ দেন। সম্মানী ছিল ৪০০ রুপি। ১৮৪৪ সালে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি ‘ইন্সপেক্টর অব কলেজেস অ্যান্ড স্কুলস ইন দ্য লোয়ার প্রভিন্সেস ইন বেঙ্গল’ পদে যোগ দেন। সেখানে সম্মানী ছিল ৭০০ রুপি। ফলে ঢাকা কলেজে আয়ারল্যান্ডের স্থলাভিষিক্ত হন টি এ ওয়াইজ।
১৮৪৭ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অব দ্য কলেজ অব হাজী মোহাম্মদ মহসীন অ্যান্ড ইটস সাবঅর্ডিনেট ইনস্টিটিউশন্স’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদন এবং ১৮৪৯-৫০ সালের ‘জেনারেল রিপোর্ট অন পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ইন দ্য লোয়ার প্রভিন্সেস অন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগস্ট মাসে শ্রদ্ধাভাজন পুরোহিত কলকাতার বিশপ ঢাকা কলেজ পরিদর্শনকালে নিম্নলিখিত স্মারকটি লিখেছিলেন, ‘এমন একটি বনেদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত, যার প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর আমি স্থাপন করেছিলাম, ২০ নভেম্বর ১৮৪১ সালে।’ এই উপলক্ষে তিনি লাইব্রেরিকে মূল্যবান কিছু রচনা উপহার দিয়েছিলেন।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকাশিত হতো ‘ইন্ডিয়ান ম্যাগাজিন অ্যান্ড রিভিউ’। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত এক সংখ্যায় আলোচিত হয়েছে ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠার কথা—১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রদ্ধাভাজন পুরোহিত ড্যানিয়েল (কলকাতার লর্ড বিশপ)। এটি যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতোই ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারির ছাই থেকে উত্থিত হলো।’
১৯৬৮ সালে প্রকাশিত নির্মল সিনহার লেখা ‘ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল ১৮১৮-১৯০৪’ গ্রন্থেও ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠার সময়কাল আলোচিত হয়েছে। কলকাতার তৎকালীন সদর বোর্ড অব রেভেনিউর সেরেস্তাদার বা অফিস প্রধান রামলোচন ঘোষ ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি স্কুলটির জন্য এক হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা পৌরসভার ১০০ বছর পূর্তিতে (১৯৬৬) প্রকাশিত, আজিমুশশান হায়দার সম্পাদিত ‘আ সিটি অ্যান্ড ইটস সিভিক বডি’ গ্রন্থেও প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে কলকাতার বিশপ কর্তৃক ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজের নামফলক উন্মোচনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এতগুলো ঐতিহাসিক প্রতিবেদন ও আকর গ্রন্থে ঢাকা কলেজের ফলক উন্মোচন ও প্রতিষ্ঠার বছর হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে একটি তারিখের কথা উল্লেখ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে মিডিয়া ও প্রাজ্ঞজনদের মাঝে বেশ শোরগোল শোনা যাচ্ছে। এ–সংক্রান্ত তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আশা করা যায়, গবেষণালব্ধ এই নিবন্ধ তদন্ত কমিটির চিন্তার খোরাক জোগাতে সক্ষম হবে এবং ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার বছর নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটবে অচিরেই।
*লেখক: গবেষক