ঢাকার আদালতের উত্তমদা

৩০ বছর ধরে ঢাকার আদালতের নিবন্ধন খাতাপত্র বাঁধাই করে চলেছেন শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা উত্তম নন্দী। ছবি: আসাদুজ্জামান
৩০ বছর ধরে ঢাকার আদালতের নিবন্ধন খাতাপত্র বাঁধাই করে চলেছেন শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা উত্তম নন্দী। ছবি: আসাদুজ্জামান

আদালতে থাকে নানা রকম নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতা। এসব খাতার পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে মামলার বিচারসংক্রান্ত নানা তথ্য। যুগের পর যুগ আদালতে এসব নিবন্ধন খাতা সংরক্ষণ করা হয়। তাই সুন্দরভাবে বাঁধাই করা হয় নিবন্ধন খাতা।

আর ৩০ বছর ধরে ঢাকার আদালতের এসব নিবন্ধন খাতা বাঁধাই করে চলেছেন উত্তম নন্দী। তিনি আদালতের কর্মচারীদের কাছে ‘উত্তমদা’ নামে পরিচিত।

৬০ বছর বয়সী উত্তম নন্দী পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা। শাঁখারীবাজারেই তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। উত্তম নন্দীর বাবা বিহারীলাল নন্দী। তাঁরা পাঁচ ভাই, পাঁচ বোন। তাঁর ভাইয়েরা ও আত্মীয়স্বজনের বেশির ভাগ শাঁখারীবাজারে শঙ্খশিল্পের কাজ করেন। কেবল উত্তম নন্দী খাতাপত্র বাঁধাই পেশার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই কাজ তিনি এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে করছেন।

একজন উত্তমদা
ঢাকার বিচারিক আদালতগুলোর পাশেই শাঁখারীবাজার। অবস্থানগত কারণে অনেক আগে থেকে আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে উত্তম নন্দীর পরিচয়।

কীভাবে আদালতের খাতাপত্র বাঁধাই করার কাজের সঙ্গে যুক্ত হন—জানতে চাইলে উত্তম নন্দী বলেন, বহু বছর আগে তিনি ভারতে যান। সেখানেই খাতাপত্র বাঁধাই করার কাজ শেখেন। এরপর ঢাকায় ফিরে খাতাপত্র বাঁধাই করার কাজে লেগে পড়েন। ৩০ বছর ধরে আদালতের খাতাপত্র বাঁধাইয়ের কাজ করে যে পারিশ্রমিক পান, তা দিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।

উত্তম নন্দী আরও বলেন, সততার সঙ্গে কাজ করায় আদালতের কর্মচারীরা তাঁকে ডেকে কাজ দেন। বছরের পর বছর সততার সঙ্গে তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন খাতা বাঁধাই করার এই কাজ করে যাবেন।

উত্তম নন্দীকে অন্তত ২০ বছর ধরে চেনেন ঢাকার আদালতের পেশকার ইফতেখার মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তমদাকে ভালো মানুষ হিসেবে চিনি। বহু বছর ধরে তিনি আদালতের নিবন্ধনের খাতাপত্র বাঁধাই করেন। উত্তমদার বিরুদ্ধে কারও কাছ থেকে কোনো অভিযোগ শুনিনি।’

সদা হাস্যোজ্জ্বল উত্তম নন্দীর কাঁধে প্রায় দেখা যায় একটি বড় ব্যাগ। সেই ব্যাগে থাকে বাঁধাই করা নতুন নিবন্ধন খাতা। এরপর এক আদালত থেকে আরেক আদালতে হেঁটে যান উত্তম নন্দী। বুঝিয়ে দেন নিবন্ধন খাতা। আবার নতুন কাজের অনুরোধ নিয়ে ফিরে যান ঘরে।

উত্তম নন্দীর তিন ছেলে। তাঁদের কেউই বাবার পেশায় আসেননি। দুই ছেলে শঙ্খশিল্পের সঙ্গে জড়িত। আরেক ছেলে অন্য পেশায়। একাই খাতাপত্র বাঁধাই করার কাজ করেন উত্তম নন্দী।

ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পেশকার শামীম আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তম দাদা আমাদের নতুন নিবন্ধন খাতাপত্র বাঁধাই করে দেন। তাঁর হাতের কাজ সুন্দর। বছরের পর বছর তাঁর বাঁধাই করা খাতা রয়েছে আদালতগুলোয়। সবাই উত্তম দাদাকে চেনেন।’

বড় আকারের একটা নিবন্ধন খাতা বাঁধাই করার বিনিময়ে উত্তম নন্দী পান ৫০০ টাকা। আর ছোট আকারের নিবন্ধন খাতা বাঁধাই করে নেন ২০০ টাকা। দীর্ঘদিন আদালতের নিবন্ধন খাতা বাঁধাই করার সুবাদে হাইকোর্ট নির্ধারিত সব ফরম ভালো করে চেনেন তিনি।

৩০ বছর ধরে ঢাকার আদালতের নিবন্ধন খাতাপত্র বাঁধাই করে চলেছেন শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা উত্তম নন্দী। ছবি: আসাদুজ্জামান
৩০ বছর ধরে ঢাকার আদালতের নিবন্ধন খাতাপত্র বাঁধাই করে চলেছেন শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা উত্তম নন্দী। ছবি: আসাদুজ্জামান

উত্তম নন্দী বলেন, ‘প্রতিদিনই আদালতে আসি। আদালতে না এলে খারাপ লাগে। খাতাপত্র বাঁধাই করা আমার কর্ম। এই কর্ম না করলে তখন খারাপ লাগে। ঢাকার মহানগর, ঢাকার দায়রা জজসহ অন্য কোর্টগুলোর খাতাপত্র বাঁধাই করার কাজ আমি করি। এসব খাতাপত্র বাঁধাই করতে লাগে বোর্ড, আঠা, কাপড়। লাগে মার্বেল কাগজ। বিভিন্ন ধরনের বোর্ড দিয়ে এ কাজটা করা লাগে। একাই আমি এই কাজ করি।’

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বহু বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই উত্তম নন্দী আদালতের কর্মচারীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছেন। এ জন্য তিনি কাজ পাচ্ছেন। উত্তম নন্দীর বাঁধাই করা খাতাগুলো যুগের পর যুগ সংরক্ষিত থাকবে, এটা অবশ্যই আনন্দের।’

উত্তম নন্দী বললেন, ‘আমি যখন আদালতে ঘুরি, দেখি আমার বাঁধাই করা নিবন্ধন খাতাপত্র সবাই ব্যবহার করছেন, সংরক্ষিত হচ্ছে, তখন খুব ভালো লাগে। যত দিন বাঁচি এ কাজই করে যেতে চাই।’