ঢাবিতে স্নাতকোত্তর করে মোহন ফিরেছেন চা-বাগানেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন মোহন রবিদাস
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন মোহন রবিদাস। একটা সময়ে চা-শ্রমিকের সন্তানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র গ্র্যাজুয়েট। পড়াশোনা শেষে মোহন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টে (বিএলএসটি) কমিউনিটি জাস্টিস ফেলো এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে সব ফেলে চা-বাগানে ফিরে গেছেন ৩১ বছরের মোহন। চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন আর অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
 মোহন চা-শ্রমিক, চা-শ্রমিকের সন্তানদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চা-বাগানের মেয়ে ও নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার থেকে বাঁচাতে কাজ করছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়েও।

প্রথম যখন ঢাকায় আসেন, তখন অনেক কিছুতেই অবাক হতেন মোহন। পাঁচতারা হোটেলের শৌচাগারে এসি দেখে মোহন অবাক হয়েছিলেন। হাই কমোড দেখে বুঝতেই পারেননি কীভাবে ব্যবহার করবেন। এ অভিজ্ঞতাগুলো মোহন তাঁর ফেসবুকেই লিখে রেখেছেন।

অভ্যস্ত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করতে করতে সবকিছুর সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মোহন। শহুরে ভাষা, হাই কমোডসহ বিভিন্ন জিনিসের ব্যবহারবিধিও ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তবে ঢাকার আয়েশি জীবন তাঁকে টানেনি। মন পড়ে থাকত ফেলে আসা চা-বাগানে। চা-শ্রমিকদের জীবনের কষ্টগুলো মনে পড়ত।

২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হতে প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন মোহন। ভর্তির পর ভাষা নিয়ে ঝামেলায় পড়েন তিনি। তাঁর মাতৃভাষা নাগ্রী এবং তিনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারতেন না। এতে অন্যরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পর মোহন ফেসবুকে বিভিন্ন সময় যাঁরা তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তখন গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকায় তিনিই ছিলেন একমাত্র চা-শ্রমিকের সন্তান।

পড়াশোনা শেষে মোহন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টে (বিএলএসটি) কমিউনিটি জাস্টিস ফেলো এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ২০১৫ সালে মোহন আবার ফিরে যান নিজের চা-বাগানে। জাগরণ যুব ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে বিভিন্ন কাজ করছেন। ছোট একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্রও চালাচ্ছেন ।
মোহনের জন্ম মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরের এক চা-বাগানে। বাবা মধু রবিদাস, মা লাখপতি রবিদাস চা-শ্রমিক ছিলেন। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। মোহনের বড় ভাই চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। অন্য এক ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। দুই বোনের মধ্যে এক বোন চার বছর বয়সী সন্তান রেখে মারা গেছেন। আরেক বোনের বিয়ে হয়েছে। থাকেন চা কোম্পানি থেকে পাওয়া দুই ঘরের বাড়িতে। বড় ভাই বিয়ে করেছেন। ছোট ঘরেই সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হয়।

মায়ের সঙ্গে মোহন
ছবি: সংগৃহীত

গত বুধবার মুঠোফোনে কথা হয় মোহনের সঙ্গে। তখনো তিনি চা-শ্রমিকদের একটি চলমান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফিরে গেলেন সেই ছোটবেলায়। যে বোন মারা গেছেন তাঁর মানসিক সমস্যা ছিল। বোনের চিকিৎসার খরচের পাশাপাশি এতগুলো মুখে খাবার তুলে দিতে বাবা রীতিমতো হিমশিম খেতেন। মোহন সেই ছোটবেলা থেকেই ঘাস বিক্রি করতেন। সপ্তাহে পাঁচ টাকার (প্রতি গরু) বিনিময়ে গরু চড়াতেন। ফলে বেশ কয়েকবারই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু থেমে যাননি। আবার পড়াশোনা শুরু করেছেন। অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়ে অনেক যাচাইবাছাইয়ের পর ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশনের স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পর্যন্ত বেশ নিরিবিলি পড়তে পারেন। তারপর আবার শুরু হয় টানাটানি। টিউশনির পাশাপাশি তখনো ঘাস বিক্রি করতে থাকেন। কলেজে ভালো ফলাফল করলে কলেজের শিক্ষকসহ অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার কথা বলেন। মোহন ছোটবেলা থেকেই চা-বাগানের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দিতেন। কলেজ পাস করার পর তত দিনে মোহনও বুঝতে পেরেছেন, পড়াশোনা ছাড়া আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। ছাগল বিক্রিসহ বিভিন্নভাবে টাকা সংগ্রহ করে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তারপর শুরু হয় ঢাকায় টিকে থাকার সংগ্রাম। তবে তখনো তিনি তাঁর চা-বাগানকে ভুলে যাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন, সেই সময় তিনি ছাড়া চা-শ্রমিকের আর কোনো সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তে আসেননি। আসবেন কীভাবে? তাঁরা তো ভালো ফলাফল করতেই পারতেন না। তাই মোহন ছুটির দিনে চলে যেতেন চা-বাগানে। সেখানকার শিক্ষার্থীদের পড়াতেন, যাতে তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন দলিত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোটা নেই। তারপর শুরু হয় কোটার দাবিতে ক্যাম্পেইন। হরিজন ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের মিলিত উদ্যোগের ফলে ২০১৩ সালের দিকে দলিত শিক্ষার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ক্যাম্পেইন চালাতে থাকেন মোহন।

মোহন বললেন, ‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত শিক্ষার্থীদের জন্য কোটা বরাদ্দের পেছনে আমি বলব আমার অবদান ছিল ৮০ শতাংশ। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ জন দলিত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। আমার চা-বাগান থেকেই বর্তমানে আমার ভাইসহ ৬ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও চা-শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন থেকে দূরে থাকেননি মোহন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গিয়ে চা-শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলার চেষ্টা করতেন। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাত উঁচু করে বসে থাকতেন। এতে অনেকেই বিরক্ত হতেন। তবে কথাগুলো বলার পর অনেকেই তাতে একমত পোষণ করতেন। এখনো ঢাকায় কোনো অনুষ্ঠানে কথা বলার সুযোগ থাকলে সেই সুযোগ সহজে ছাড়েন না। চা সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে মোহন জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে চাকরি না করে আবার সেই আন্দোলন-সংগ্রাম বা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকার বিষয়টি মোহনের পরিবার সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তবে মোহনের ভাষায়, চাকরি আর আন্দোলন একসঙ্গে হয় না।

জীবনে চলতে হলে তো টাকার দরকার? এ কথার প্রত্যুত্তরে মোহন বললেন, তিনি পান-সিগারেট খান না। বাজে কোনো নেশা নেই। তাই মোবাইলে কথা বলার মতো কিছু টাকা আর পকেটে ৫০০ টাকা থাকলেই মাস পার করে দিতে পারেন। যেকোনো আন্দোলনে দিনের পর দিন ওই এলাকায় গিয়ে থাকতে হয়। তখন তিনি কার বাড়িতে খাবেন, তাই নিয়ে লেগে যায় মারামারি।

মোহনের উদ্যোগে চা বাগানের নারীদের জন্য বানানো স্যানিটারি প্যাড
ছবি: সংগৃহীত

মোহনকে একটি বিষয় ভাবায়। ভালো একটি চাকরি করলে বড় ভাইয়ের (১২০ টাকা দৈনিক মজুরি) ওপর চাপটা কমত। পরিবার ভালোভাবে থাকতে পারত। আবার সেই ভাবনা দূরে সরে যায় যখন থাকেন আন্দোলনে। হারমোনিয়ামে সুর তুলে গান গেয়ে অন্যদের উজ্জীবিত করেন মোহন। নিজে গান লিখেন, সুর করেন। বললেন, ‘আমি আমার জীবনটাকে নিয়ে শতভাগ সুখী। আমার নিজের কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই। নেই কোনো আকাঙ্ক্ষা, পিছুটানও নেই। বিয়ে-সংসার এসব নিয়েও ভাবার সময় পাইনি।’

স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে সংগ্রাম
চা-বাগানে ফিরে যাওয়ার পর মোহন খেয়াল করেন তাঁর বাগানের হাসপাতালে পুরুষের চেয়ে নারী ও মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কেন বেশি—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানতে পারেন, নারী ও মেয়েদের বেশির ভাগই জরায়ুমুখের ক্যানসারসহ নানান জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, চা-বাগানের মেয়ে ও নারীরা পিরিয়ড বা মাসিকের সময় অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করেন। অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলেন না। সচেতনও না। ২০১৭ সাল থেকে মোহনের কাজের তালিকায় যোগ হয় মাসিক নিয়ে সচেতনতা তৈরি, বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ।

মোহন বললেন, ‘শুরুতে আমি নিজেও মাসিক নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পেতাম। নারী ও মেয়েরাও লজ্জায় কথা বলতেন না।’ পরে ঢাকার চিকিৎসক বন্ধুদের সহায়তায় চা-বাগানে ক্যাম্পের আয়োজন করেন। এতে লজ্জা কাটতে থাকে। নারীরাও কথা বলা শুরু করেন।

চা-বাগানের মেয়ে ও নারীদের বাঁচাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন চেয়ে ২০১৮ সালে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন মোহন। তাঁর সেই আহ্বানে সেই সময় প্রায় ২০০ জন ব্যক্তি ২০০ মেয়েকে নিয়মিত প্যাড দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে এখনো অনেকে দিচ্ছেন।

বাজারে কেনা স্যানিটারি প্যাডের পাশাপাশি ইউটিউব দেখে কলা গাছের তন্তু ও কাপড়কে একসঙ্গে করে বিশেষ পদ্ধতিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানানোর উদ্যোগ নেন। চা-বাগানে বর্তমানে এই প্যাডের ট্রায়াল পর্ব চলছে। চা বাগানের নারীরা বাজারে যেসব স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় তা ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাই শুধু কাপড় দিয়েও স্যানিটারি প্যাড বানাচ্ছেন। স্যানিটারি প্যাডের উদ্যোক্তা মোহন তাঁর বানানো প্যাডের ব্র্যান্ড নাম দিয়েছেন ‘শিখা প্যাড’। প্যাডগুলো ধুয়ে আবার ব্যবহার করা যায়। চা-বাগানের নারীরা স্যানিটারি প্যাড কিস্তিতে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। মোহনের আয়ের উৎসও এটি। মোহন স্বপ্ন দেখছেন, ভবিষ্যতে বড় একটি কারখানায় নিজেদের ব্র্যান্ডের স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদিত হবে।

মোহন হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার মায়ের নাম লাখপতি, অথচ ছোটবেলা থেকে শুরু করে সারা জীবনই আমাদের কষ্টে কাটাতে হচ্ছে। তবে আবারও বলব, আর্থিক কষ্ট থাকলেও আমি আন্দোলন, গানবাজনা নিয়ে খুব ভালো আছি। চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু কাজ করতে চাই।’