ঢাবির রাজিয়া এখন কেঁচো সারচাষি

প্রিয় ক্যাম্পাসে বাবা–মায়ের সঙ্গে রাজিয়া
ছবি: সংগৃহীত

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে গোবর-কেঁচো নিয়ে কাজ করছি। এতে অনেকে নাক সিটকান। প্রথম দিকে আমার কাজের জায়গায় অনেকে থুতুও ফেলেছেন। অনেকেই বলেন, চাকরি পাচ্ছি না, তাই বলে শিক্ষিত মেয়ে হয়ে গোবর-কেঁচো নিয়ে কাজ করতে হবে? শুরুতে বাবা-মাও কিছুটা আপত্তি জানিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে।’

অনেকেই বলেন, এত পড়াশোনা করে লাভ কী হলো সেই তো কেঁচো নিয়েই পড়ে থাকতে হচ্ছে। তাঁদের বলি, মাস্টার্স করার পরই তো কেঁচো নিয়ে কাজ শুরু করলাম, চাকরির পেছনে তো ঘুরিনি। তাই চাকরি পাচ্ছি না তা তো বলা যায় না।
রাজিয়া সুলতানা

গত সোমবার মুঠোফোনে কথাগুলো বললেন রাজিয়া সুলতানা (সুমি)। তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক ইউনিয়নের গড়িয়ার পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। গত বছরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ফলাফলও ভালো। সেই মাসেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরে আসেন রাজিয়া। এক-দেড় মাস পরেই নিজের বাড়িতেই শুরু করেন কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির কাজ। এটি একটি জৈব সার। গোবর খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে। সেই মলের সঙ্গে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে আসে। কেঁচোর এই মলই কেঁচো কম্পোস্ট নামে পরিচিত। এখন রাজিয়ার দিন কাটছে গোবর-কেঁচোর সঙ্গে।

আত্মবিশ্বাসী রাজিয়া বললেন, ‘আমরা কৃষক বাবার মেয়ে। বাবা অন্যের জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ করেন। একবার বন্যায় বাবা একাই বিলের বুকসমান পানিতে নেমে ধান কাটা শুরু করেন। আমি বু’কে বললাম, লজ্জা-শরম বাদ দিয়ে চল ধান কাটি। আমরা দুই বোন ধান কেটেছি। স্মৃতি হিসেবে একটা ছবিও তুলেছিলাম। ধান মাড়াই করা, সেদ্ধ করাসহ বিভিন্ন কাজ করেই তো আমরা বড় হয়েছি। তাই কৃষিকাজে আগ্রহ বেশি ছিল।’

সার তৈরিতে ব্যস্ত দুই বোন
ছবি: সংগৃহীত

বরাবরই তাঁদের টানাটানির সংসার। ভাই না থাকায় বাবা-মা এমনকি তাঁদের দুই বোনকেও আশপাশের মানুষজনের কাছ থেকে নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। দুই বোন সব সময়ই চেয়েছেন, বাবা-মায়ের জন্য শক্তি হয়ে দাঁড়াতে। মানুষের কটু কথাই তাঁদের উদ্যমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে—এমনটাই দাবি রাজিয়ার।

বড় বোন শামীমা বেগমকে নিয়ে রাজিয়া গড়ে তুলেছেন শামীমা অ্যাগ্রো ফার্ম। বড় বোনের প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, ‘আমার বু’র নামেই ফার্মটি করা হয়েছে। বোনের উদ্যম এবং পরিশ্রমেই এ উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেছে। বোন আমাদের পরিবারের জন্য যা করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি চাই আমাদের উদ্যোগটি বোনের নামেই পরিচিতি পাক।’

শামীমা নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠতেই বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর স্বামী দেশের বাইরে থাকেন। শামীমা বাবার বাড়ির হাল ধরেন। ছোটবেলায় বিয়ে হওয়ায় শামীমা আর পড়াশোনা করতে পারেননি। তবে রাজিয়ার উদ্যোগেই দীর্ঘ ১৪ বছর পর শামীমা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা শুরু করেছেন। আর শামীমার মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে।

বড় বোন শামীমা বেগমকে নিয়ে রাজিয়া গড়ে তুলেছেন শামীমা অ্যাগ্রো ফার্ম
ছবি: সংগৃহীত

কেমন করে এই কেঁচো সারের পরিকল্পনা এল জানতে চাইলে রাজিয়া জানালেন, গত বছর তাঁরা দুই বোন মাশরুম চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কাজ শুরু করার পর কিছু সমস্যায় তা আর এগোয়নি। মাশরুম প্রশিক্ষণেই কেঁচো সারের কথা জানতে পারেন। তাই ভাবলেন, বসে থাকলে তো চলবে না। ইউটিউবে এ–সংক্রান্ত অনেকগুলো ভিডিও দেখে মনে সাহস পান। এরপরই নেমে পড়েন মাঠে। কিছু জানার প্রয়োজন হলেই গুগল সার্চ করেন। পাশাপাশি এ সম্পর্কিত পড়াশোনা, কৃষি কর্মকর্তা এবং কেঁচো সার নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের কাছ থেকেও পরামর্শ, সহযোগিতা নেন।

গত বছরের মে মাসে কাজ শুরু করলেও ডিসেম্বর মাস থেকে সার বিক্রি শুরু করতে পেরেছেন। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার টাকার সার বিক্রি করেছেন। একদম পুঁজি ছাড়া শুরু করা উদ্যোগে এইটুকু সাফল্যেই তাঁরা খুশি।

রাজিয়া-শামীমার বাবা মো. সেকান্দার আলী সৌদি আরবে টাইলস মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছেন বহু বছর। তবে তেমন টাকাপয়সা জমাতে পারেননি। চার বছর আগে দেশে চলে আসেন। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন চিকিৎসায় বেশ খরচ হয়ে যায়। এখন সেকান্দার অন্যের জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ করেন। আর তাঁর স্ত্রী ও রাজিয়া-শামীমার মা রুমি বেগম ঘর সামলান।

রাজিয়া প্রথমে তাঁর বাবাকে রাজি করিয়ে বাড়ির একটি জায়গায় লম্বা বারান্দার মতো বানিয়ে নেন। সেখানে শুরুতে ২৪টি স্যানিটারি রিং বসান। গোবর কালচার করেন। তারপর কেঁচো কেনেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া ১৬ হাজার টাকা আর বড় বোনের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা—বিনিয়োগ বলতে ছিল এইটুকুই সম্বল। বড় বোন শামীমা আগে থেকেই গরু পালন করায় তাঁর জন্য কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।

রাজিয়া সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের মে মাসে কাজ শুরু করলেও ডিসেম্বর মাস থেকে সার বিক্রি শুরু করতে পেরেছেন। এ পর্যন্ত ১৮ হাজার টাকার সার বিক্রি করেছেন। একদম পুঁজি ছাড়া শুরু করা উদ্যোগে এইটুকু সাফল্যেই তাঁরা খুশি। সময় দিলে এবং লেগে থাকলে তাঁরা সফল হবেন এ বিশ্বাস দুবোনের।

এলাকায় শুরুতে শুধু শামীমা-রাজিয়া এই দুই বোনই কেঁচো সার নিয়ে কাজ করতেন। তবে এক বছরে এই দুই বোনের উদ্যোগেই তাঁরাসহ ১০ জন নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘চেতনায়ন সংঘ’ নামের একটি সংগঠন।

রাজিয়া বলেন, কাজ শুরুর পর ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুল হায়দার বেপারি কাছ থেকে ৫০ জন নারী প্রশিক্ষণ নেন। তবে শেষ পর্যন্ত ১০ জন নারী মাঠে কাজ করছেন। কাজ শুরুর পর অর্থের সংকট দেখা দিলে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম। তাঁর সঙ্গে বদরুল হায়দার বেপারি এবং শামীমার অর্থ যোগ হয়ে নয় হাজার টাকা হয়। চেতনায়ন সংঘের নামে এ তহবিল থেকেই নারীদের রিং, কেঁচোসহ বিভিন্ন উপাদান কিনে দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল বিনা সুদে এ টাকা শোধ করতে হবে। তারপর আবার এ টাকা থেকেই অন্য আগ্রহী নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হবে। এভাবেই একসময় নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়বে। কেউ বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো উৎপাদন করতে না চাইলে নিজের সংসারের প্রয়োজন মেটানোর জন্যও কাজটি করতে পারেন।

বদরুল হায়দার বেপারি প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রাজিয়া তাঁকে খুঁজে বের করেন। মুঠোফোনে বিভিন্ন পরামর্শ চান। শামীমা-রাজিয়াদের উদ্যোগ বর্তমানে আহামরি ভালো অবস্থানে পৌঁছে গেছে তা বলার মতো সময় আসেনি। তবে রাজিয়া উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় মার্কেটিং এর জায়গাটি দ্রুত ধরতে পেরেছেন। আর মার্কেটিং এর বিষয়টিই কেঁচো সার ব্যবসায় প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বদরুল হায়দার বেপারি ২০১২ সাল থেকে কেঁচো সার উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। রাজিয়ার প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে ভালো কাজ করছেন এমন সেরা তিনজনের একজন রাজিয়া। স্বল্প পুঁজি নিয়েও এই দুই বোনের ব্যবসার যে গতি তা বেশ ইতিবাচক। রাজিয়ার উদ্যোগেই অন্য নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সংঘ পরিচালিত হচ্ছে। আমি নিজেই ওই সংঘের কাজে যুক্ত থাকতে চাই বলে আগ্রহ প্রকাশ করি। পরে বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিমও যুক্ত হন।’

গোবর খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে। সেই মলের সঙ্গে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে আসে। কেঁচোর এই মলই কেঁচো কম্পোস্ট নামে পরিচিত
ছবি: সংগৃহীত

করোনায় একদিকে সব শেষ করে দিচ্ছে, আবার তাঁদের দুই বোনের জীবনে নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগটিও করে দিয়েছে। বাবার আয় দিয়ে পরিবারের পাঁচজন মানুষের চলা বেশ কঠিন ছিল। দুই বোনের আয়ে তাতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে তা বলা না গেলেও তাঁরা আগের থেকে ভালো আছেন।

আট কেজি কেঁচো দিয়ে রাজিয়াদের উদ্যোগের শুরু, বর্তমানে কেঁচোর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ২৭ কেজি। মাসে খরচ বাদ দিয়ে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো হাতে থাকে।

রাজিয়া বলেন, কেঁচো সার উৎপাদন বেশ লাভজনক। কেঁচো একবার কিনলেই হয়। আর গ্রামে গোবরও সহজলভ্য এবং দামও কম। এক মণ গোবরের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা। অন্যদিকে কেঁচো জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে রাজিয়া ও শামীমার বারান্দায় ১৯টি স্যানিটারি রিং এবং ইট–সিমেন্ট দিয়ে ১৭টি ছোট ছোট ঘরে কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। আট কেজি কেঁচো দিয়ে রাজিয়াদের উদ্যোগের শুরু, বর্তমানে কেঁচোর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ২৭ কেজি। মাসে খরচ বাদ দিয়ে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো হাতে থাকে।

রাজিয়া জানালেন, তিনি অনলাইনে যা অর্ডার পান সেই অর্ডারে অন্য নারী উদ্যোক্তাদের সারও বিক্রি করে দেন। রাজিয়া বলেন, ‘সোমবারই প্রথম একজন বাড়িতে এসে ৪০ কেজি কেঁচো সারের অর্ডার দিয়ে গেলেন। এভাবে অর্ডার পেলে পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।’

বর্তমানে রাজিয়া ও শামীমার বারান্দায় ১৯টি স্যানিটারি রিং এবং ইট–সিমেন্ট দিয়ে ১৭টি ছোট ছোট ঘরে কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে

ফেসবুকে শামীমা অ্যাগ্রো ফার্মের পেজে রাজিয়া নিয়মিত কেঁচো সারের উপকারিতা, কেঁচোচাষিদের আড্ডাসহ বিভিন্ন আয়োজন করে অন্যদের সচেতন করার চেষ্টা করছেন। রাজিয়া বলেন, ‘অনেকেই বলেন, এত পড়াশোনা করে লাভ কী হলো সেই তো কেঁচো নিয়েই পড়ে থাকতে হচ্ছে। তাঁদের বলি, মাস্টার্স করার পরই তো কেঁচো নিয়ে কাজ শুরু করলাম, চাকরির পেছনে তো ঘুরিনি। তাই চাকরি পাচ্ছি না তা তো বলা যায় না।’

রাজিয়া হেসে বললেন, শুধু গোবর-কেঁচো নয়, ১৮টি ছাগল, গরু, হাঁস-মুরগি এগুলোর সঙ্গেও দিন কাটে। আর যে কেঁচো দেখে প্রথমে নিজেই ভয় পেতেন, সেই কেঁচোকে এখন নিজের সন্তানের মতোই মনে হয়। একটি কেঁচোও কোনো কারণে খারাপ থাকলে মনে হয়, আহা, বেচারা কষ্ট পাচ্ছে।