ঢিলেমি, অধ্যক্ষ নেই ১৪১ কলেজে

  • উপাধ্যক্ষ নেই ২৮টিতে

  • মোট শিক্ষকের পদ ফাঁকা ২,৮৭৮

  • ১২,৫১৯টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আটকে আছে

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ নেই প্রায় এক বছর ধরে। কলেজটিতে উপাধ্যক্ষ পদ নেই। ফলে একজন সহকারী অধ্যাপক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ওই কলেজে ৩৪টি শিক্ষক পদের ১০টি ফাঁকা। যদিও শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮০০।

চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, অধ্যক্ষ না থাকায় শিক্ষা ও প্রশাসনিক নানা কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। বড় কোনো জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি পড়েছে নেতৃত্বের সংকটে। এখন কোনো রকমে দৈনন্দিন কাজ চলছে।

চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজের মতো দেশে এখন ১৪১টি সরকারি কলেজে অধ্যক্ষের পদ ফাঁকা। দেশে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৬৩২। শতকরা হিসাবে, ২২ শতাংশের কিছু বেশি কলেজে অধ্যক্ষ নেই। শুধু অধ্যক্ষ নয়, ২৮টি কলেজে উপাধ্যক্ষ পদও শূন্য। যাঁরা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করান, সেই শিক্ষকের পদ ফাঁকা ২ হাজার ৮৭৮টি, যা মোট পদের ১৮ শতাংশ। বড় শহরের বড় কয়েকটি কলেজ ছাড়া বেশির ভাগ সরকারি কলেজেই শিক্ষকসংকট রয়েছে।

অধ্যক্ষ করার মতো শিক্ষকের অভাব নেই। কিন্তু শূন্য পদ পূরণে মনোযোগ কম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাজ ব্যাহত।

অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার মতো শিক্ষকের কোনো অভাব নেই। সাধারণত অধ্যাপকদের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের সরকারি কলেজে সাড়ে তিন শ জনের বেশি অধ্যাপক রয়েছেন। আর সহযোগী অধ্যাপক রয়েছেন ২ হাজারের মতো। তাঁদের মধ্য থেকেও ছোট কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া যায়।

সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয় যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন শ শিক্ষক মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি না থাকায় কলেজগুলোর শীর্ষ এই দুই পদে নিয়োগ আটকে আছে। অবশ্য অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে না পারলেও করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও শিক্ষকদের নিয়মিত বদলি করা হচ্ছে। বদলির ক্ষেত্রে অনেক সময় তদবির ও নানা অনিয়মের ঘটনাও ঘটে। ১৭ সেপ্টেম্বর এক আদেশে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে চার মাস আগে মারা যাওয়া এক শিক্ষককেও বদলি করা হয়। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক সভাপতি ও রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, কলেজগুলোতে প্রশাসনিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত কাজগুলো অধ্যক্ষের নেতৃত্বে হয়ে থাকে। সেখানে নিয়মিত অধ্যক্ষ না থাকলে সমস্যা হবেই। আর আর্থিক কোনো বিষয় থাকলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষরা দায়িত্ব নিতে চান না। তিনি বলেন, আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ছাত্রসংগঠনের নেতাদের মোকাবিলা করা। সেটাও নিয়মিত অধ্যক্ষ ছাড়া সম্ভব নয়। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাসের বিষয়টি সমন্বয়ের জন্যও নিয়মিত অধ্যক্ষ থাকা দরকার।

যেসব কলেজে অধ্যক্ষ নেই

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে পুরোনো কলেজ ৩২৯টি। এর মধ্যে ৬৩টির অধ্যক্ষ পদ ফাঁকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালে বেসরকারি থেকে সরকারি হওয়া ৩০৩টি কলেজের মধ্যে অন্তত ৭৮টিতে অধ্যক্ষ নেই।

অনেক বড় কলেজেও শীর্ষ পদটি খালি। এর মধ্যে বরিশালের সরকারি বি এম কলেজ, যশোরের সরকারি এম এম কলেজ, যশোর সরকারি সিটি কলেজ, ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, গৌরীপুর সরকারি কলেজ, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ, শেরপুর সরকারি কলেজ, রাজশাহীর নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ, চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ও ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ অন্যতম।

অনেক কলেজ আছে, যেখানে একাধিক অধ্যাপক রয়েছেন। যাঁরা অধ্যক্ষ হওয়ার যোগ্য। যেমন নীলফামারী সরকারি কলেজে অধ্যাপক রয়েছেন পাঁচজন। কিন্তু কলেজটিতে অধ্যক্ষের পদ ফাঁকা গত ৩০ এপ্রিল থেকে। কলেজটির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সেখানে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। অধ্যক্ষ না থাকায় দৈনন্দিন কাজগুলো কোনো রকমে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ বড় কলেজগুলোর মধ্যে একটি। সেখানে উপাধ্যক্ষের পদ ফাঁকা সাত-আট মাস ধরে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজেও উপাধ্যক্ষ নেই এক বছরের বেশি সময় ধরে। উপাধ্যক্ষ না থাকা কলেজের মধ্যে আরও আছে ভোলা সরকারি কলেজ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ, লালমনিরহাট সরকারি কলেজসহ ২৮টি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোন কোন কলেজে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ পদ খালি, তা খুঁজে বের করে পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য ইতিমধ্যে দরখাস্ত নেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। অক্টোবরের মধ্যে পদগুলো পূরণের কাজ শেষ হবে।

নিয়োগে নতুন নিয়ম

গত সরকারের (২০১৪-১৮) সময়ে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যদের তালিকা করে সেখান থেকে সরকারি কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হতো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের নিয়ম থেকে সরে এসেছে।

গত জুনে একটি নতুন নীতিমালা হয়েছে। তাতে মৌখিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়। নতুন নিয়মে প্রতিবছর জুলাই ও ডিসেম্বর মাসে কলেজের শীর্ষ দুই পদের জন্য আগ্রহী শিক্ষকদের কাছ থেকে অনলাইনে আবেদন নেওয়া হবে। জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সুখ্যাতি বিবেচনা করে একটি কমিটি যোগ্য শিক্ষকদের একটি প্যানেল তৈরি করবে। সেখান থেকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হবে। যোগ্য শিক্ষক বাছাইয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নীতিমালার আলোকে ইতিমধ্যে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদের জন্য প্রায় সাড়ে তিন শ শিক্ষক আবেদন করেছেন।

তবে শিক্ষকদের অনেকের অভিযোগ, সাধারণত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হয়। পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্য অধ্যাপকেরা অধ্যক্ষ হতে পারেন না। শিক্ষক বদলিতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।

মাউশির সাবেক মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, মানসম্মত শিক্ষা চাইলে কলেজগুলোতে অবশ্যই শূন্য পদ পূরণের পাশাপাশি নতুন পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। অনেক অধ্যাপক আছেন, তাঁদের অধ্যক্ষ পদে দ্রুত পদায়ন করা সম্ভব।

শিক্ষকের পদও খালি

মন্ত্রণালয় ও মাউশির তথ্য অনুযায়ী, দেশের পুরোনো সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকের অনুমোদিত পদ আছে ১৫ হাজার ৬৫২টি। প্রয়োজনের তুলনায় পদসংখ্যা অনেক কম। এর মধ্যে আবার প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭৮টি পদ শূন্য।

অধ্যাপকের অনুমোদিত পদ ৫৪৭টি; যার ১৮৫টি শূন্য। সহযোগী অধ্যাপকের অনুমোদিত ২ হাজার ৩০০ পদের মধ্যে ২৮৩টি, সহকারী অধ্যাপকের ৪ হাজার ৪৭১ পদের মধ্যে ৩৭৫টি এবং প্রভাষকের ৮ হাজার ৩৩৪ পদের মধ্যে ২ হাজার ৩৫টি পদই শূন্য।

সাধারণত সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হয় বিসিএসের সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগে দীর্ঘ সময় লাগে। ফলে সব সময় কলেজগুলোতে শিক্ষকের অনেক পদ শূন্য থাকে। এতে পাঠদানে সমস্যা হয়। মাউশি সূত্র জানায়, কলেজগুলোতে নতুন করে সাড়ে ১২ হাজার পদ সৃষ্টির প্রস্তাব কয়েক বছর ধরে ঘুরছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি মন্ত্রণালয় যেমন মন্ত্রী ছাড়া চলতে পারে না, তেমনি অধ্যক্ষ ছাড়া একটি কলেজ ঠিকমতো চলতে পারে না। অধ্যক্ষ না থাকলে কার্যত একটি কলেজ মুখ থুবড়ে পড়ে।’ তিনি বলেন, অধ্যক্ষ শূন্য থাকা কলেজগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত শিক্ষার কাজগুলো কেবল প্রশাসনিক দৃষ্টিতে না দেখা।