তদন্তেও কোকেনের গন্তব্য অজানা

চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ হওয়া কোকেনের চালানের গন্তব্য গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাড়ে চার মাসের তদন্তেও জানা যায়নি। তেলের চালানে কোকেন শনাক্তের ঘটনায় লন্ডনপ্রবাসী দুই বাংলাদেশিসহ আটজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, চালানটিতে ৩৭০ লিটার তরল কোকেন রয়েছে। এ মামলায় সাক্ষী রাখা হয়েছে ৫৮ জনকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম মো. শাহজাহান কবিরের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। কোকেন জব্দের ঘটনায় চট্টগ্রামের বন্দর থানায় গত ২৭ জুন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এ মামলা করা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে চোরাচালানের অভিযোগে এই মামলায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারাও সংযোজন করা হয়।
গত ৬ জুন পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কোকেন সন্দেহে চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের চালান জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরপর ২৭ জুন তেলের চালানের ১০৭টি ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামের নমুনায় কোকেন শনাক্ত হয়। প্রতিটি ড্রামে ১৮৫ কেজি করে সূর্যমুখী তেল রয়েছে। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাসায়নিক পরীক্ষাগারসহ চারটি পরীক্ষাগারে তেলের চালানের দুটি ড্রামের (৯৬ ও ৫৯ নম্বর) নমুনায় কোকেন শনাক্ত হয়।
গতকাল আদালত প্রাঙ্গণে তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, লন্ডনপ্রবাসী দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় কোকেনের চালানটি কোথায় যাচ্ছিল তা শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি। দুজনের অবস্থান জানতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া মেলেনি।
অভিযোগপত্রে যে আটজনকে আসামি করা হয়েছে তাঁরা হলেন লন্ডনপ্রবাসী চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের ফজলুর রহমান ও মৌলভীবাজারের রাজনগরের বকুল মিয়া, তেলের চালানটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খানজাহান আলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা, কসকো বাংলাদেশ শিপিং লাইনসের ব্যবস্থাপক এ কে আজাদ, পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মন্ডল গ্রুপের বাণিজ্যিক নির্বাহী আতিকুর রহমান, সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মেহেদী আলম, সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইফুল আলম ও আবাসন ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল। এর মধ্যে আসামি ফজলুর রহমান ও বকুল মিয়া পলাতক। গত বুধবার জামিনে ছাড়া পেয়েছেন সাইফুল আলম। বাকি পাঁচ আসামি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছেন।
এই আটজন সম্পর্কে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, গোলাম মোস্তফা আরেক আসামি মেহেদি আলমের ফুফাতো ভাই। আবার মেহেদি আলমের ভগ্নিপতি ফজলুর রহমান। আসামি মোস্তফা কামাল হচ্ছেন বকুল মিয়ার ফুফাতো ভাই। আবার মোস্তফা কামালের ভাতিজা আতিকুর রহমান। তবে অভিযোগপত্রে তেলের চালানটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান খানজাহান আলী লিমিটেড চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তদন্তে চালানটি আনার পেছনে নুর মোহাম্মদের জড়িত থাকার তথ্য মেলেনি। তাঁর অগোচরে গোলাম মোস্তফা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে চালানটি দেশে আনতে বকুল মিয়াকে সহায়তা করেন।
যেভাবে চালানটি আসে: অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সূর্যমুখী তেলভর্তি ১০৭টি ড্রাম আমদানি করা হয় বলিভিয়া থেকে। সেখান থেকে স্থলপথে উরুগুয়ের মন্টেভিডিও বন্দরে আনার পথে বলিভিয়ার কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নমুনা পরীক্ষা ছাড়া চালানটি কোনো গন্তব্যে তা পাঠাতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করে। কিন্তু বলিভিয়ার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমসের ওই চিঠি গোপন করে সড়কপথে চালানটি মন্টেভিডিও বন্দরে নিয়ে আসে। উরুগুয়ে থেকে চালানটি সিঙ্গাপুর বন্দরে আসে। সেখান থেকে চালানটি কসকো শিপিং লাইনসের কনটেইনারে করে গত ১১ মে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, লন্ডন থেকে আসামি ফজলুর রহমান চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁর শ্যালক মেহেদী আলমকে কোকেনের চালানটি আনার বিষয়ে অবহিত করেন। মেহেদী তাঁর মামাতো ভাই গোলাম মোস্তফাকে বিষয়টি জানান। এরপর দুজনে ফজলুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোন ও ই-মেইলে যোগাযোগ করেন। পরে লন্ডন থেকে ফজলুর রহমান খানজাহান আলী লিমিটেডের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে সূর্যমুখী তেলভর্তি ১০৭টি ড্রামের বিএল (পণ্যের মালিকানা দলিল) গোলাম মোস্তফার কাছে কুরিয়ারে পাঠান।
পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, বকুল মিয়া আসামি মোস্তফা কামালকে জানান, ভারত থেকে রাজু নামের এক ব্যক্তি ৮ জুন বাংলাদেশে আসবেন। কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় তিনি আসতে পারেননি। আরেক আসামি আতিক তাঁর ই-মেইল থেকে চালানটি ভারতের কোনো বন্দরে স্থানান্তরের জন্য সহায়তা চেয়ে কসকো শিপিং লাইনসের ব্যবস্থাপক এ কে এম আজাদের সাহায্য চান।
আগামী রোববার অভিযোগপত্রটি গ্রহণের বিষয়ে আদালতে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কাজী মুত্তাকী ইবনু মিনান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, কোকেন জব্দের ঘটনার মাদক মামলায় আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগপত্রে কোনো ত্রুটি থাকলে আগামী রোববার রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তা আদালতকে জানানো হবে।