তবু চলে গেলে, মিজান!

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান

ঘণ্টা তিনেক আগে আজ (গতকাল) সন্ধ্যায় মতি ভাইয়ের অফিসঘরে আনিসুল হকের মুখে ডাক্তারের ‘জবাব’ দেওয়ার কথা শুনে নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল। মতি ভাই চুপ হয়ে গেলেন। সাজ্জাদ শরিফ অস্ফুটে কী একটা বললেন। আনিসের চোখ ছল ছল। কান্নার দমক গোপন করতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। সাততলায় এসে টেবিলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে ওঠা সোহরাব ভাইয়ের পিঠে হাত চেপে দাঁড়াই। সহকর্মীরা নির্বাক। ততক্ষণে খবরটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সাততলায় বসেই যেন অন্যান্য ফ্লোরের সহকর্মীদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

আমাদের মিজান ভাই চলে গেলেন। মিজান, একদিন আপনি আমাকে বয়সের অধিকারে আপনাকে ‘তুমি’ বলতে অনুরোধ করেছিলেন। তুমি শুনতে পেলে না মিজান, আজ আমি চোখের জল দিয়ে এ লেখায় তোমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছি।

আরও পড়ুন

মাসাধিক কাল হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গেলে তুমি। তোমার স্ত্রী–পুত্র–কন্যা–ভাইবোন–আত্মীয়–স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষীরা চরম উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা নিয়ে তাদের সর্বস্ব পণ করে তোমাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে। দেখেছি, তোমার পাশে ছিল প্রথম আলো পরিবার। অ্যাডমিনের উৎপল চক্রবর্তীকে ডেকে সম্পাদক মতি ভাইকে বলতে শুনেছি, ‘মিজানের জন্য যা কিছু দরকার করব। দেখবেন যেন কোনো ত্রুটি না হয়।’ অ্যাডমিনের উৎপল, কবীর প্রতিদিন হাসপাতালে দৌড়াতেন। তাঁরাও এ সময় তোমার পরিবার–পরিজনের অংশ হয়ে উঠেছিলেন। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত খোঁজখবর, যোগাযোগ রেখেছেন। সহকর্মীদের প্রতিদিনের জটলায় তোমার সুস্থ হওয়া না–হওয়াই ছিল যেন একমাত্র আলোচ্য। আজ হয়তো জানা গেল, তোমার অবস্থা খানিকটা ভালো। সবাই বেশ চাঙা হয়ে উঠলাম। পরদিনই হয়তো মন খারাপ–করা খবর। এই আশা–নিরাশার দোলাচলে কী দুঃসহ দিন কেটেছে তোমার পরিবারের! ঢাকার বড় বড় ডাক্তারদের জড়ো করা হলো তোমার চিকিৎসায়। তোমার বন্ধু–স্বজনেরা আকুল হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোমার সুস্থতার জন্য দোয়া, প্রার্থনা করেছে। সবকিছু বিফল করে তবু চলে গেলে তুমি। আজ কাকে ডেকে বলব, এভাবে যেতে হয় না ভাই।

এই সাততলায় আমি বসি, তুমিও বসতে। রাত গভীর হলে স্বভাবতই ফাঁকা হয়ে যেত এই তল্লাট। আমাকে ইদানীং বেশি রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। তুমি কখনো থাকতে, কখনোবা নানা যোগাযোগ সেরে অফিসে ফিরে আসতে। বেশ দূরে–দূরেই আমাদের বসবার জায়গা। টেলিফোনে খুব জোরে জোরে কথা বলতে তুমি। কত দিন আমি চেঁচিয়ে বলেছি, মিজান টেলিফোনটা বন্ধ করে কথা বলেন, টেলিফোন ছাড়াই ওই প্রান্তের শ্রোতা আপনার কথা শুনতে পাবে। একদিন কথা শেষ করে তুমি আমার পাশে এসে ঘন হয়ে বসলে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে, অরুণ দা, আপনি আমার উচ্চ স্বরে কথা বলার জন্য বিরক্ত হন, মাইন্ড করেন? শিশুর অনাবিল সারল্যমাখা সে জিজ্ঞাসা। আমি হো হো করে হেসে তোমার পিঠে হাত রাখি।

আরও পড়ুন

তোমার একটা গুণের খবর বলি। অনেকে হয়তো জানে না। তুমি খুব ভালো আবৃত্তি করতে। এই তো সেদিন তোমাদের সম্পাদকীয় বিভাগের সহকর্মীদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলে। সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে গেলাম আমি। তোমার চমৎকার কণ্ঠে, প্রমিত উচ্চারণে সে আবৃত্তি শুনে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর তোমাকে নিয়ে রসিকতা করলে তুমি মৃদু হেসে রসিয়ে রসিয়ে সেটা উপভোগ করতে। এসব স্মৃতি কোনো দিন ভুলব না ভাই।

নানা কথা মনে পড়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে লিখতে বসে সবকিছু অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে। জানো তো, আমি খুব একটা লিখিটিখি না। কিন্তু মনে হচ্ছে, কিছু না লিখলে এই মুহূর্তের দম বন্ধ করা অবস্থা থেকে পরিত্রাণ নেই। তোমার এই দুঃসহ মৃত্যুর দহন থেকে পালানোর জন্যই বুঝি এ লেখা।

তোমার পরিবারের সঙ্গে তো আমার জানাচেনা নেই। তোমার বড় ছেলেটিকে দু–একবার দেখেছি, কথা বলেছি। তোমার মা, স্ত্রী, পুত্র–কন্যা আর কীর্তিমান ভাইয়েদের কথা শুনেছি তোমার মুখেই। ভাবছি এই শোক তাঁরা কী করে সামলাবেন? কোথায় দাঁড়াবেন তোমার বউ–ছেলে–মেয়ে। যন্ত্রণার এই গুরুভার কী করে সইবে তোমার বর্ষীয়সী জননী। কার কাছে পরামর্শ চাইবে তোমার ভাইয়েরা?

আরও পড়ুন

আমাদের মিজান—মিজানুর রহমান খানের সাংবাদিকতার ওজন বাংলাদেশের মানুষ জানে। এ পেশায় তোমার সততার কথাও সর্বজনবিদিত। দেশকে তোমার অনেক দেবার ছিল ভাই। তোমার মতো চব্বিশ ঘণ্টার সাংবাদিক আমি খুব কম দেখেছি। অন্য সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে দিনে–রাতে–শয়নে–স্বপনে সাংবাদিকতার এক অনন্য ব্রতচারী হয়ে উঠেছিলে তুমি। আর, একই সঙ্গে তোমার মতো সরল–সুন্দর এবং তুখোড় বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের দেখা মেলে কদাচিৎ। তুমি কি জেনেছিলে ভাই, তোমার পরিবার–পরিজনের মতো সহকর্মীরাও তোমাকে খুব ভালোবাসত।

যা কিছু লিখব বলে ভেবেছিলাম, কিছুই হলো না বুঝি তার। অসংলগ্নই হয়ে রইল এ লেখা। রবীন্দ্রনাথে ভর করে বলি,

‘দূর এসেছিল কাছে

ফুরাইলে দিন, দূরে চলে গিয়ে

আরও সে নিকটে আছে’

* [email protected]