তবু লতিফাকে যেতে হচ্ছে পোশাক কারখানায়

লতিফা ও আরিফা। মা মারা গেছেন। বাবা অসুস্থ।  সংসারের খরচ চালাতে লতিফা খুঁজছে পোশাক কারখানার চাকরি ষ ছবি: প্রথম আলো
লতিফা ও আরিফা। মা মারা গেছেন। বাবা অসুস্থ। সংসারের খরচ চালাতে লতিফা খুঁজছে পোশাক কারখানার চাকরি ষ ছবি: প্রথম আলো

রানা প্লাজা ধসের ১৬ দিন পরে ১০ বছরের আরিফা খুঁজে পায় মায়ের লাশ। এখন পরিবারটির কাছে পোশাক কারখানাগুলো একেকটি মৃত্যুপুরী। তবুও আরিফার বড় বোন ১৪ বছরের লতিফাকে এখন পোশাক কারখানাতেই কাজ খুঁজতে হচ্ছে। না হলে যে সংসার চলে না।
লতিফা ও আরিফা রংপুরের গ্রামের বাড়িতে থাকত। তাদের মা রীনা বেগম রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ কারখানায় হেলপারের কাজ পান। বাবা লুৎফর সাভারেই রিকশা মেরামত করেন। গত মঙ্গলবার সাভারের ইমান্দিপুরের গাবতলার বাসায় কথা হয় লুৎফর রহমান ও তাঁর দুই মেয়ের সঙ্গে। লুৎফর রহমান বলেন, ‘বিল্ডিং ভাঙার খবর শুনে দৌড় পাড়লাম। রাস্তাভর্তি লোক রানা প্লাজার দিকে দৌড় পারবার নাগছে। বিল্ডিংয়ের কাছে গিয়া দেখি দুইটা লাশ পড়ি রইছে। লাশ দেখি আমার মাথা চক্কর দিবার নাকছে।’
লুৎফর জানান, পর দিন তাঁর দুই মেয়েসহ অন্য স্বজনেরা খোঁজাখুঁজিতে যোগ দেয়। হাঁপানির কারণে তিনি ছুটোছুটি করতে পারছিলেন না। তিন দিন পর থেকে লুৎফর মেয়ে আরিফাকে নিয়ে অধরচন্দ্র মাঠের স্কুলেই (যেখানে লাশগুলো জমা করা হচ্ছিল) বসে ছিলেন। ১৬ দিন ধরে তাঁর ১২ জনের মতো স্বজন, প্রতিবেশী সাভারের সবগুলো হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ, মিটফোর্ড মর্গ ও সাভার সিএমএইচে রীনার খোঁজ করেছেন। ১৬তম দিনে আরিফাই খুঁজে পায় মায়ের লাশ।
আরিফা বলে, ‘লাশ আলে পরে আমি (বডি ব্যাগের) ঢাকনা খুইলা দেখতাম। প্রথম প্রথম গন্ধ নাগত। পরে আর কিছু মনে হয়নি।’ আরিফা বলে যায়, ‘১৬তম দিনে পিকাপে করে একটা লাশ এল। গাড়ি থেকে নামিয়ে বারান্দায় রাখার পর সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এর মধ্যেই দেখি ব্যাগের ওপরে লেখা—রীনা বেগম, স্বামী লুৎফর রহমান, রংপুর। দেইখাই আমি আব্বারে ডাকলাম। মুখ দেখে চিনা যায় না। তবে মায়ের পকেটে ইউনিয়ন পরিষদের একটা সার্টিফিকেট আছিল। সেইটা দেইখাই আমাগরে লাশ দিছে।’
লুৎফর জানান, গত ১ এপ্রিল রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ কারখানায় যোগ দেন রীনা। তাঁর পরিচয়পত্র তৈরির জন্য সেদিন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের সনদটা পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আর সেই সনদের কারণেই তাঁর লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে আরিফা সেই সনদটা সযত্নে রেখে দিয়েছে।
লুৎফর বলেন, এরপর প্রশাসন থেকে দেওয়া ২০ হাজার টাকা দিয়েই ইমান্দিপুরে লাশ দাফন করা হয়। জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দুই মেয়েকে ডেকে দুই লাখ টাকার চেক দিয়েছেন। সেই টাকা দুই মেয়ের নামে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) করেছেন। কিন্তু এখন সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে বড় মেয়েকে কাজে দিতে হচ্ছে।
লতিফা বলে, ‘এখন গার্মেন্টসের কথা শুনলে বুক কাঁপে। মনে হয় ঢুকলেই শ্যাষ। কিন্তু উপায় তো নেই। বাবা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। সংসার চলে না।’