এমন অবস্থা যে কে কারে বাঁচাবে: দুঃসহ সেই ঘটনা নিয়ে এসআই কামরুল

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহত ১৪ জন ভর্তি আছেন রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে
ছবি: মানসুরা হোসাইন

নজরুল মণ্ডলের হাতে ও ঠোঁটে দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে গেছে। কোমরের নিচে বেশ খানিকটা জায়গা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। স্ত্রীর সাহায্য ছাড়া শোয়া-বসা করতে পারেন না। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঘুরে আসতে হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকেও।

৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের একজন নজরুল মণ্ডল। বর্তমানে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি।

কাভার্ড ভ্যানের চালক নজরুল বসা অবস্থা থেকে শুতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলেন। বললেন, সেদিনের ঘটনায় তাঁর গাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছিল। দগ্ধ হন তিনি। এতে তাঁর শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিয়েছে। এখন চোখের সামনে যা দেখেন, সবই কুয়াশার মতো ঝাপসা মনে হয়।

আমদানি-রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২৪ বছর আগে চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম কোনো কনটেইনার ডিপোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল। ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছিল, কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। উত্তপ্ত হলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।

নজরুলের এক মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আরেক মেয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর। সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারেন না তিনি। মুঠোফোনের নম্বর চাইলে ম্লান হেসে বললেন, ‘পকেটে মানিব্যাগ আর ফোন ছিল। দুর্ঘটনার পর কে নিয়া গেছে, বলতে পারি না।’

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডে পাশাপাশি বিছানায় নজরুলসহ সীতাকুণ্ডের ঘটনায় আহত মোট ১৪ জন ভর্তি আছেন। মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে।

তিনবার অস্ত্রোপচার এসআই কামরুলের

আহত ব্যক্তিদের একজন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল ইসলাম। এ পর্যন্ত তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। পায়ের চারটি আঙুল ভেঙে গেছে। ডান পায়ের হাড় কেটে গেছে। ঘটনার সময়ের বর্ণনা দিয়ে বললেন, ‘এমন অবস্থা যে কে কারে বাঁচাবে?’

কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহত নজরুল মণ্ডল
ছবি: মানসুরা হোসাইন

কামরুল ইসলাম বললেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করা আর ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন লোকজন। তাঁরা যাতে ঘটনাস্থলের কাছে যেতে না পারেন, সে চেষ্টা করছিলেন। খুব বেশি হলে ৭ মিনিট সময় পেয়েছিলেন। তারপরই বিস্ফোরণের শব্দ। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তবে কামরুল ইসলামের জ্ঞান ছিল। বললেন, ‘ওই জায়গা থেকে আল্লাহ বের করে আনছেন।’

হাসপাতালে কত দিন থাকতে হবে, জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বললেন, এখান থেকে ছাড়া পেলে তাঁকে আবার হয়তো অর্থোপেডিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সেখানেও লাগবে অনেক দিন। আবার কবে কাজে ফিরতে পারবেন, তা নিশ্চিত নয়।

সাড়ে ছয় বছর বয়সী মেয়ের বাবা কামরুল সরকার ও তাঁর পুলিশ বিভাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানান, চিকিৎসায় সার্বিক সহযোগিতা পাচ্ছেন তিনি। বার্ন ইনস্টিটিউটের সেবার মানও ভালো।

কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে উঠেছিল। আগুন, উত্তাপ ও ধোঁয়া প্রত্যক্ষভাবে ছড়িয়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। আর এর দূরবর্তী প্রভাব পড়েছে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক লোক।

৪ জুনের আগুনের ঘটনার পর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, বিস্ফোরণে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেবে সরকার। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন ১৯ বছর বয়সী বদরুজ্জামান রুবেল। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ম্লান হেসে বললেন, ‘মনে হইছিল তো গেছিলাম গা। অনেক লোক তো মারা গেছে। আমি ফিরতে পারব, তা মনে হয় নাই।’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ
ছবি: সংগৃহীত

আহত রুবেল বললেন, আগুন লেগেছে শুনে পরিস্থিতি বুঝতে একটু কাছাকাছি গিয়েছেন। তবে ১০ সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারেননি। তার আগেই যা হওয়ার তা-ই হয়। জানালেন, তাঁর মুঠোফোনটি গাড়ির মধ্যে ছিল। পরে আর পাননি। হয়তো কেউ নিয়ে গেছে।

পা থেকে চামড়া নিয়ে লাগানো হয়েছে কোমরে

৫২০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি গাড়িচালক মো. সজীবের কোমরের অংশ পুড়ে গেছে। পা থেকে চামড়া নিয়ে সেখানে লাগানো হয়েছে। চোখের সমস্যা আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে। সজীব বললেন, আগুন লাগার সময় প্যান্ট পরা থাকায় কোমর বেশি পুড়েছে। দেড় বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে হাসপাতালে থাকতে দিচ্ছে না। তাকে তার নানির কাছে রেখে আসতে হয়েছে। সজীবের ভাষ্য, জীবনে তিনি এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা শোনেননি, চোখে তো দেখেনইনি।

সজীব রাজধানীর আগারগাঁও থেকে ঘটনার দুদিন আগে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন সীতাকুণ্ডে। ঘটনার দিন গাড়ি খালি হয়নি দেখে খেতে গিয়েছিলেন। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। গাড়ি যেখানে ছিল, সেখানে থাকলে শারীরিক ক্ষতি কম হতো বলে মনে করছেন সজীব।

আমদানি-রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২৪ বছর আগে চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম কোনো কনটেইনার ডিপোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল। ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছিল, কনটেইনার ডিপোটিতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ছিল।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড
ছবি: কৃষ্ণ চন্দ্র দাস

হাসপাতালের বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মো. রবিন মিয়া। পাশে বসা স্ত্রী বন্যা আক্তার। রবিন বালিশ থেকে একটু মাথা তুললেই ছোট চামচে করে তাঁর মুখে ভাত দিচ্ছিলেন বন্যা। ছোট পানির বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে তা দিয়ে পানি খাওয়াচ্ছিলেন। এই দম্পতির বিয়ের বয়স মাত্র এক বছর। খেতে খেতেই রবিন জানালেন, শরীরের পেছন দিকে ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে।

৪ জুনের ঘটনার পর শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ঘোষণা দিয়েছেন, বিস্ফোরণে নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেবে সরকার। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।

বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রোগীরা জানালেন, তাঁরা শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক পেয়েছেন। এ ছাড়া ডিপোর মালিকপক্ষ থেকে তিন দফায় ১৫ হাজার করে টাকা পেয়েছেন। তবে তাঁদের সুস্থ হওয়া, কাজে ফেরা—সবই অনিশ্চিত। তাই এ সহায়তা দিয়ে আর কত দিন চলা সম্ভব, তা জানেন না।

আরও পড়ুন

‘আমার জন্য একটু দোয়া করবেন’

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা গাড়িচালক সুমন হাওলাদার বললেন, ‘এক চোখে শুধু কুয়াশা দেখি।’ সুমন চার ও আড়াই বছর বয়সী দুই সন্তানের বাবা। ১৮ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। আর কত দিন থাকতে হবে, তা-ও অনিশ্চিত। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় শুধু বললেন, ‘আমার জন্য একটু দোয়া করবেন।’

দুর্ঘটনায় এসব মানুষের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও, আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। কেউ কেউ ওয়ার্ডে আসা স্বজনদের সঙ্গে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। অনেকেই আবার মুঠোফোনে কথা বলছিলেন স্বজনদের সঙ্গে।

হাসপাতালে ভর্তি শেখ মঈনুল হক বিএম কনটেইনার ডিপোর ইমপোর্ট সুপারভাইজার। বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। পাশে বসা তাঁর ছোট ভাই রাশেদ বলেন, মঈনুল হক এক মেয়ের বাবা। তাঁর স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আগুনে মঈনুলের চোখ ও শরীরের পেছনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজ শরীরের অন্য জায়গা থেকে চামড়া এনে পুড়ে যাওয়া স্থানে লাগানো হয়েছে। পায়খানা করতে গেলে সেলাই ছিঁড়ে যায় বলে তাঁকে তরল খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।

দুর্ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা
ছবি: জুয়েল শীল

আহত পুলিশ সদস্য ইমরুল কায়সার চোখে কম দেখছেন। পায়ে দুটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। পিঠ পুড়ে গেছে। ঘটনার দিন ডিপোর ভেতরেই দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। বললেন, আগুন লাগার পর মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করছিল, ভিডিও করছিল। তিনি প্রায় ৩০ জনকে ঘটনাস্থল থেকে সরাতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন

আমির শেখ (১৯) গাড়িতে পণ্য লোড-আনলোড করার কাজ করতেন। জানান, একটি দোকানে বসে ছিলেন। এরপরই আগুনের ঝলকানি দেখতে পান। তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তখন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না।

ঘটনাস্থল থেকে ৩০ বা ৪০ হাত দূরে ছিলেন গাড়িচালক মো. রবিন হোসেন। ঘটনার পর থেকে চোখে ঝাপসা দেখছেন। রবিন ছয় ও তিন বছর বয়সী দুই সন্তানের বাবা। অপর দিকে ২১ বছর বয়সী চালক সাইফুল ইসলামের কোমর ও পায়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত দুইবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

ডিপোতে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো কিছু তো ছিল না বলে দাবি করেন ডিপোর ডেপুটি ম্যানেজার (অপারেশন) জসিম উদ্দিন। আগুনে তাঁর পা ও চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। দুর্ঘটনার বিষয়ে বলেন, তিনি ডিপোর মালিকপক্ষ থেকে চার লাখ টাকা পেয়েছেন। এ ছাড়া শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকার চেক পেয়েছেন।

দুর্ঘটনায় এসব মানুষের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও, আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। কেউ কেউ ওয়ার্ডে আসা স্বজনদের সঙ্গে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। অনেকেই আবার মুঠোফোনে কথা বলছিলেন স্বজনদের সঙ্গে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসাধীন, তাঁদের সেই অর্থে আর মৃত্যুঝুঁকি নেই। তবে চোখের সমস্যায় দীর্ঘদিন ফলোআপে থাকতে হবে। পুড়ে যাওয়া জায়গায় স্ক্রিন ড্রাফটিং বা চামড়া লাগানোসহ বিভিন্ন চিকিৎসায়ও দীর্ঘমেয়াদি। তাই তাঁদের ভোগান্তি কমতে সময় লাগবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সার্বিকভাবে এই রোগীদের তত্ত্বাবধান করছে।’