তাঁরা এখন রিকশাচালক

করোনাকালে চাকরি হারিয়ে এখন রিকশাচালক কিশোরগঞ্জের জয়নাল।
ছবি: আসাদুজ্জামান

কিশোরগঞ্জের জয়নাল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। করোনা পরিস্থিতিতে বহু মানুষের মতো চার মাস আগে তিনি চাকরিচ্যুত হন। দিশেহারা জয়নাল কীভাবে স্ত্রী আর এক ছেলের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেবেন, সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে যান। প্রথম দুই মাস আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালান। পরে বাধ্য হয়ে রিকশা চালানো শুরু করেন। রিকশা চালিয়ে যে আয়, তা দিয়ে এখন সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে চাকরিজীবী থেকে রিকশাওয়ালা হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি।

চালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসা মাদারীপুরের বিন্দু জালাল এখন রিকশাচালক।
ছবি: আসাদুজ্জামান

জয়নাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আট বছর ধরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করেছি। যে বেতন পেতাম, তা দিয়ে খুব ভালো চলছিলাম। কল্পনাও করিনি, আমার চাকরি যাবে। আমি হয়ে যাব রিকশাচালক। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম বাস্তবতায় আমি আজ রিকশাওয়ালা।’

কেবল জয়নাল নন, বৃহস্পতিবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল, কাকরাইল ও মগবাজার এলাকা ঘুরে অন্তত ১০ জন নতুন রিকশাওয়ালার খোঁজ মিলেছে। যাঁরা আগে অন্য পেশায় ছিলেন, তবে করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে নিরুপায় হয়ে এখন তাঁরা রিকশাচালক। নগরজীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তাঁরা।

চলমান কঠোর বিধিনিষেধে নগরের মোড়ে মোড়ে রিকশাওয়ালারা যাত্রী তোলার জন্য অপেক্ষায়।
ছবি: আসাদুজ্জামান

এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হওয়া সরকারি কঠোর বিধিনিষেধে অফিস, আদালত, গাড়ি, দোকানপাট সব বন্ধ। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, যানজটের নগরীতে এখন মানুষের আনাগোনা কম। তারপরও নগরীর মোড়ে মোড়ে রিকশাওয়ালার আনাগোনা বেশি।

বেশির ভাগ রিকশাওয়ালার ভাষ্য, যাত্রীর তুলানায় রিকশা বেশি। এ জন্য আগের থেকে আয় কমে গেছে। তারপরও যে যাত্রী তাঁরা পাচ্ছেন, যে আয় হচ্ছে, তাতে সন্তুষ্ট। কারণ, গেল বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা শুরু হওয়ার পর টানা ৬৬ দিন কঠোর বিধিনিষেধে সরকারি–বেসরকারি অফিস, আদালত, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঢাকা নগরীতে যাঁরা রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে হয়রানির মুখে পড়েন। মোড়ে মোড়ে রিকশা ধরে উল্টে রাখা হয়েছিল। রিকশাওয়ালাদের সেই অসহায়ত্বের ছবি তখন গণমাধ্যমে আসে। গত রমজান মাসেও শুরু হওয়া সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে নগরীর অনেক রিকশা ধরে উল্টে রাখা হয়েছিল। তবে এবারের চিত্র আলাদা।

গাড়ির চালক হতে এসে এখন রিকশাওয়ালা
গাড়ির চালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাদারীপুর থেকে দুই মাস আগে ঢাকায় আসেন মাদারীপুরের যুবক বিন্দু জালাল (২৫)। পরে চানখারপুলের একটি বেসরকারি চালক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ভর্তি হন তিনি। বাড়ি থেকে আনা ১২ হাজার টাকার মধ্যে ভর্তি বাবদ খরচ হয়ে যায় ৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে তিনি থাকা-খাওয়ার খরচ মেটান। মাস দেড়েক প্রশিক্ষণ নিতেই শুরু হয়ে যায় কঠোর বিধিনিষেধ। ফলে প্রশিক্ষণও বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিন্দু জালাল রিকশা চালানো শুরু করেছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ের সামনে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বিন্দু জালাল প্রথম আলোকে বলেন, বাধ্য হয়ে সাত দিন ধরে তিনি গুলিস্তান, আজিমপুর, চানখারপুল এলাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। সেই আয় দিয়ে চলছেন।

ঋণগ্রস্ত হয়ে কৃষক শহিদুল এখন ঢাকায় রিকশাচালক।

চাঁদপুরের কৃষক শহিদুল ঢাকায় রিকশাচালক
ষাটোর্ধ্ব শহিদুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। এলাকায় কৃষিকাজ করে তিনি সংসার চালাতেন। কিন্তু করোনার প্রভাব পড়ে তাঁর সংসারেও। টানাটানি করে সংসার চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর গত বছর চাঁদপুর থেকে ঢাকায় চলে আসেন শহিদুল। তখন থেকে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, কিস্তি পরিশোধ করছেন। তবে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে আয় কমে গেছে। এ জন্য দুশ্চিন্তায় তিনি।

রিকশাচালক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে আমি ঢাকায় এসে রিকশা চালাচ্ছি। কিন্তু করোনায় এই বিধিনিষেধে আয় কমে গেছে।’

বরিশালের কিশোর নাঈম, যখন তার হেসেখেলে জীবন কাটানোর কথা, তখন মা–বাবার দায়িত্ব তার কাঁধে।

কিশোর নাঈম এখন রিকশাচালক
বরিশালের নাঈম (১৪) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি কারখানায় চাকরি করত। মাসিক বেতন ছিল সাত হাজার টাকা। তবে করোনায় মাস ছয়েক আগে তার চাকরিটা চলে যায়। এরপর থেকে সে রিকশা চালায়।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় যাত্রাবাড়ী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর রিকশাচালক নাঈম বলল, ‘দয়াগঞ্জের একটি কারখানায় কাজ করে যা পেতাম, তা মা–বাবার কাছে তুলে দিতাম। তবে সাত মাস আগে চাকরি চলে যায়। এরপর থেকে রিকশা চালাচ্ছি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা শহরে একজন রিকশাচালক মাসে গড়ে ১১ হাজার ১৫১ টাকা আয় করেন। রিকশাভাড়া, গ্যারেজের খরচ—এসব বাদ দিয়েই এ অর্থ আসে।
১৯৮৬ সালে সিটি করপোরেশন সর্বশেষ ৭৯ হাজার ৫৫৪ রিকশার লাইসেন্স দেয়। এরপর থেকে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ। তবে ঢাকা শহরে এখন আনুমানিক ১১ লাখ রিকশা আছে।