তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান

ঢাকার সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরে মওলানা শপিং কমপ্লেক্সে উত্তরণ বিউটি পারলারে কাজ করছেন হিজড়া সোহাগীছবি: প্রথম আলো

মা গো, তুমি কেমন আছ? বাবা খেয়েছে তো? নিজের যত্ন নিয়ো ঠিকমতো। কোনো চিন্তা নেই মা, আমি তো আছিই। পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সবার ভাষা এখন এমনই। এখন তাঁরা পরিবারের সদস্যদের ভরসা দেন।

জীবনের একটি সময়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের কাছে হাত পেতে ৫–১০ টাকা সংগ্রহ করতেন। আজ তাঁরা নতুন ভোরের আলোর সঙ্গে স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সম্মানজনক কাজে। দিন শেষে ঘরে ফেরেন নির্ভয়ে। খোঁজ নেন মা–বাবা, ভাই-বোনের।

সমাজের অভদ্র মানুষদের ঠোকর খেয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা এসব মানুষ আজ মাথা উঁচু করে পথ চলেন। আমরা তাঁদের হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলি। ফারসি ভাষায় ‘হিজড়া’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ‘সম্মানিত ব্যক্তি’। আক্ষরিক অর্থে সম্মানিত হলেও ভিন্ন শরীরী উপস্থাপনার কারণে সমাজে তাঁদের অবস্থান দুর্বল।

আজ তাঁরা নিজেরা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। ঢাকার সাভার ও ধামরাই উপজেলার হেমায়েতপুর, পল্লী বিদ্যুৎ ও ধামরাই রথখোলা এলাকার ৩টি বিউটি পারলারে ও একটি ফুড কর্নারে তাঁদের মতো ১২ জন হিজড়া কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ ছেলেমেয়ে কাজ করছেন আরও ১১ জন।

মা-বাবার আদর, ভাই–বোনদের ভালোবাসা নিয়ে ছোটবেলায় তাঁরা বেড়ে ওঠেন। এ চিত্র একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু গোল বাঁধে যখন তাঁরা একটু বড় হয়ে ওঠেন, যখন তাঁদের কথাবার্তা, শরীরী উপস্থাপনার ভিন্নতা দেখা দেয়। তখন মানুষ একটু অন্যভাবে তাকায়। অনন্যা বণিক, শাম্মী, সোহাগী ও নাসিমা—সবার গল্প প্রায় একই।

ধামরাই রথখোলা এলাকায় উত্তরণ বিউটি পারলারে সম্প্রতি কথা হয় পারলারের পরিচালক অনন্যা বণিকের সঙ্গে। অনন্যার ভাষায়, ‘একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যাই। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলাম। সমাজের মানুষ আমাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু এরপর সব বদলে যেতে থাকে, প্রতিবেশীরা মাকে বলতে থাকেন, “আপনার ছেলেটা ভালো নাচে, কিন্তু কেমন যেন।” পরে প্রতিবেশীদের চোখেমুখে আমার প্রতি, আমার পরিবারের প্রতি অবজ্ঞা দেখেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আপন বড় ভাইয়ের নিষ্ঠুরতা দেখেছি। কেন নাচ করি, বাইরে যাই, সাজি—সেগুলোর জবাব দিতে হতো। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো আমাকে। আজ আমি পারলার চালাই। নিজে আয় করি।’

শাম্মী পরিচালনা করেন আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার উত্তরণ বিউটি পারলারের অপর শাখাটি। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি কে—এ প্রশ্ন সব সময়ই নিজেকে করতে হতো। উত্তর পেতাম, আমি মানুষ ও অসুস্থ নই। আমার চারপাশের মানুষগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বুঝিয়ে দিয়েছে, আমি অন্য কেউ, আমি তাদের মতো নই। এভাবে পৃথিবীটা দিন দিন আমার কাছে ছোট হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা একসময় বোঝা মনে করে। বাবার কাছেও একটা সময় আশ্রয় পাইনি। নিজেই তাদের মুক্তি দিয়েছি। বাইরের পৃথিবীটা আরও ভয়ংকর। হোটেলে থালাবাটি ধোয়ার কাজটিও আমাকে দেয়নি কেউ। বাধ্য হয়েই গুরুর (হিজড়াদের সরদার) কাছে চলে গেছি। চুরি–ডাকাতি বাদে সব বাজে কাজই করতে হয়েছে। পরে আমি নতুন জীবনের সন্ধান পাই। আমাকে উত্তরণ বিউটি পারলার করে দেওয়া হয়। পারলার দেওয়ার পর প্রথম প্রথম কেউ সাজতে এলে আমাকে দেখে চলে যেত। বউ সাজালে বিয়ে ভেঙে যাবে, এমন মন্তব্যও শুনতে হয়েছে আমাকে। তবে এখন অনেকের ধারণা বদলে গেছে। আজ গর্ব নিয়ে পথ চলি।’

গুরুর নির্দেশে প্রতিদিন তাঁরা বেরিয়ে যেতেন কালেকশনে। সভ্য মানুষগুলোর অসভ্য আচরণ তাঁদের মেনে নিতে হতো অসহ্য যন্ত্রণায়। দিন শেষে গুরুর আশ্রয়ে ফিরে এসে কাঙ্ক্ষিত কালেকশন না হলে গালিগালাজ শুনতে হতো। গুরুর খাওয়া, গুরুর ঘুমানোর পরই কেবল তাঁদেরও সুযোগ হতো। শাম্মী, সোহাগী ও নাসিমা স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বারবারই ওড়নায় চোখ মুছে নেন।

অনন্যা বণিক, শাম্মী আক্তার, সোহাগী দাবি করেন, গত চার বছরে তাঁদের কাছ থেকে দেড় থেকে ২০০ হিজড়া প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, যাঁরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন বিউটিশিয়ানের কাজ করছেন। এ ছাড়া লিঙ্গ–ভেদাভেদের বিষয়টি ঘোচাতে তাঁদের সঙ্গে ১২–১৫ জন স্বাভাবিক মেয়েরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। নাসিমার ফুড কর্নারে দুজন হিজড়ার সঙ্গে কাজ করছেন তিনজন।

সরকারসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের কাছে নিজেদের পরিচয় লিঙ্গভেদে নয়, মানুষ হিসেবেই দেওয়ার অনুরোধ তাঁদের। তাঁরা বলেন, ‘আমরা বেরিয়ে এসে সম্মানজনক কাজ করছি। এতে হিজড়াদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ভাঙতে শুরু করেছে। এটি ধরে রাখতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ যেন খারাপ পেশায় না যান, সে জন্য শেল্টার হোম ও টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’

সমাজের পিছিয়ে পড়া অযত্ন–অবহেলা আর প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার অন্ধকারে বসবাসকারী এসব মানুষ আলোর পথে নিয়ে এসেছের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। সাভার ও ধামরাইয়ের অনন্যা বণিক, শাম্মী আক্তার, নাসিমা ও সোহাগীর গল্প শুনে তাঁদের ইচ্ছা অনুসারে নিজ উদ্যোগে তাঁদের জন্য বিউটি পারলার ও ফুড কর্নার করে দিয়েছেন তিনি।

হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাইরে রেখে কখনোই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুস্থ–সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তাঁদের উন্নয়নে ব্যক্তি উদ্যোগের বাইরেও সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আপন করে নিতে হবে আমাদের চারপাশের বঞ্চিত এবং লাঞ্ছনা, নিপীড়নের শিকার মানুষদের।